পরীক্ষা দিয়ে এসে প্রিয়জন’কে বলেছি
-নির্ঘাত ফেল করবো!
দেশে বাসার সবাইকে জানালাম
-পাশ করার কোন সম্ভাবনা নেই।
এই কথা শুনে আমার পিঠাপিঠি বড় বোন, আমরা এক’ই সঙ্গে এসএসসি-এইচএসসি পাশ করেছি; সে বলেছে
– তুই তো আজীবন’ই পরীক্ষা দিয়ে এসে বলতি খারাপ হয়েছে; কিন্তু রেজাল্ট ভালো হতো।
আমি বললাম
– এই পরীক্ষায় পাশ করা অসম্ভব!
তাছাড়া শুনেছি পৃথিবীর সব চাইতে কঠিন কিছু ভাষার মাঝে এটি একটি। আমি কোন কোর্স করিনি; কোথাও গিয়ে শিখিও’নি। স্রেফ বাসায় নিজে নিজে বই পড়ে যা শিখেছি; সেটার ভিত্তিতে ভাবলাম যাই- পরীক্ষা দিয়ে দেখি; এই দেশের ল্যাংগুয়েজ টেস্টে পাশ করা যায় কিনা।
পরীক্ষা দিয়ে মনে হয়েছে- নাহ, পাশ করবো না।
কাল রেজাল্ট দিয়েছে। শুধু পাশ না, আমি “ভেরি গুড” গ্রেড নিয়ে পাশ করেছি!
রেজাল্ট দেখে বাসায় জানালাম- আমি অনেক ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করেছি!
এইবার আমার বোন বলছে
– তুই না বলেছিলি পাশ করবি না?
ঘটনা হচ্ছে- আমার বোন জীবনের সকল পরীক্ষা’ই ভালো দিয়েছে। পরীক্ষা দিয়ে তার সব সময় মনে হতো- ভালো’ই তো দিয়েছি। আর আমি জীবনে কোন পরীক্ষা দিয়ে মনে হয় না বলতে পেরেছি- ভালো হয়েছে। তবে রেজাল্ট দেয়ার সময় দেখা যেত উল্টো!
বিষয় হচ্ছে আমার বোন সেই অর্থে পড়তো’ই না! পরীক্ষা সামনে আসলে সে বলত- আরে ধ্যাত, এতো পড়ে ফায়দা নেই, বানিয়ে বানিয়ে দিয়ে দেব! (আপনাদের জানিয়ে রাখি, সে এমন কিছু নেই যেটা বানিয়ে বানিয়ে দেত না!)
আর আমি সকল কিছু মুখস্ত করে পড়ে শেষ করে ভাবতাম- আরও তো অনেক কিছু পড়ার বাকী রয়ে গেল!
এই জন্য’ই বোধকরি জ্ঞানী লোকেরা বলেছে- যত পড়বেন, তত মনে হবে- কিছুই তো জানি না।
গতকাল রেজাল্ট দেয়ার পর প্রিয় মানুষটা জিজ্ঞেস করেছে
-তুমি এতো ভালো নাম্বার পেলা, তাহলে কি করে তোমার মনে হলো তুমি ফেল করবা?
এখন আমি তাকে কি করে বলি- আমার সত্যি সত্যি’ই মনে হয়েছে আমি ফেল করবো।
পরীক্ষা দেয়ার পর মনে হয়েছে- অমুক বইতে তো ব্যাপারটা এমন ভাবে পড়েছিলাম, কিন্তু পরীক্ষায় তো আমি ভিন্ন ভাবে দিয়ে এসছি! তমুক বইতে তো লিখেছিল- এভাবে বলতে হবে। আমি তো অন্য ভাবে বলে এসছি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা হোক এই লেখা যারা এই পর্যন্ত পড়েছেন, তাদের জানিয়ে রাখি- এটি আমার “এলোমেলো” ভাবনার লেখা। এই লেখার তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই। নেই কোন মেসেজ।
বছর খানেক আগে আমাদের এখানে করোনা লকডাউন শুরু হবার পর ভেবেছিলাম- কি করা যেতে পারে ঘরে বসে। এরপর মনে হলো- এই দেশে ভাষা শেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। যদিও এর কোন দরকার নেই। এরপরও ভাবলাম- বসেই তো আছি।
পাঁচটা বই কিনে এনে পড়া শুরু করলাম। ফলাফল- এখন আমি এই দেশের ভাষা “ভালো” বুঝতে পারি, এই সার্টিফিকেট পেয়ে গিয়েছি।
গত সপ্তাহ থেকে আমাদের এখানে আবার লকডাউন শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি খুব’ই ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। এখন ভাবছি, এই লকডাউনে কি শেখা যায়। ফ্রেঞ্চ কিংবা স্প্যানিশ ভাষাটা শিখে ফেলা যেতে পারে।
আমি কখনোই আগে এমন ছিলাম না। ১৭ বছর আগে ইউরোপে আসার পর আমার এক সুইডিশ সহকর্মী একদিন আমাকে বলেছিল
– তোমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষজন জীবনে একটা বিশাল অংশ কোন কিছু না করেই কাটিয়ে দেও। চাকরি না থাকলে, কাজ না থাকলেও তো নিজে নিজে অনেক কিছু শেখা যায়, নিজেকে উন্নত করার জন্য।
আমার কাছে ওর এই কথাটা পছন্দ হয়েছিলো। কারন আমার সত্যি’ই মনে হয়েছে- আমরা বাংলাদেশিরা জীবনের বেশিরভাগ অংশ স্রেফ শুয়ে-বসে থেকে কিংবা আলাপ-আলোচনা, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দেই।
এর সব কিছুর’ই দরকার আছে। এটি’ই আমাদের সৌন্দর্য। আমরা বাংলাদেশিরা এমন’ই। কিন্তু সেই সঙ্গে অলস সময় টুকু’র কিছু অংশ যদি কাজে লাগানো যেত; তাহলে আমরা সবাই বোধকরি কিছু না কিছু’তে অন্তত স্কিলড হতে পারতাম।
ইউরোপে এসে প্রথম যে জিনিসটায় আমি অভিভূত হয়েছিলাম; সেটা হচ্ছে – এখানে যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে; তারাও কিছু না কিছু জানে।
কেউ গীটার বাজিয়ে; কেউ মূকাভিনয় দেখিয়ে ভিক্ষা করছে। কেউ এমনি এমনি হাত পাতে না। আপনাদের জানিয়ে রাখি, এখানে ভিক্ষাও একটি পেশা।
১৭ বছর আগে যখন প্রথম এসছিলাম, তখন নিজেকেই প্রশ্ন করেছি- আমার কি এই দেশে ভিক্ষা করার যোগ্যতা টুকু আছে? আমি তো পড়াশুনার বাইরে জীবনে আর কিছুই শিখিনি।
তখন বয়েস ছিল ২১ বছর। আমার জীবনে বাকী অংশের গল্প পুরো’ই ভিন্ন। প্রতি সামারে যখন’ই সময় পেয়েছি, কিছু না কিছু শিখেছি। গীটার বাজাতে পারি। ইউকুলেলে বাজাতে পারি। হারমনিকা বাজাতে পারি। নানান ভাষা শিখেছি। শিখেছি অন্য আরও অনেক কিছু।
আর এই সবই আমি করেছি- আমার ফ্রি সময় টুকুতে। সামারে যখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকে কিংবা যখন’ই লম্বা একটা ছুটি পেয়েছি অথবা প্রতিদিন কাজের ফাঁকে আধ ঘণ্টা সময় বের করে নিয়ে যখন যা শিখতে ইচ্ছে করেছে; সেটা শিখেছি।
আমার ওই সুইডিশ বন্ধু, সে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এক্সপার্ট। অর্থাৎ দক্ষিন এশিয়া নিয়েই সে গবেষণা করে। ওর বলা সেদিনকার ছোট্ট একটা কথা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
অলস সময় টুকু’তে শুয়ে বসে না থেকে- কিছু একটা শিখে ফেলুন। কোথাও যেতে হবে না। কারো কাছ থেকেও শিখতে হবে না। কোন টাকাও খরচ করতে হবে না। স্রেফ নিজে নিজে চেষ্টা করেই এখন অনেক কিছু শেখা যায়। জীবনের যে কোন পর্যায়ে সেটা কাজে লাগতে পারে।
আপনারা যারা আমার এই লেখাটা শেষপর্যন্ত পড়েছেন; তাদেরকে ধন্যবাদ। কারন আমার এই লেখায় রাজনীতি নিয়ে কিছু নেই। নেই দুই পক্ষের রেষারেষির গল্প। স্রেফ নিজের চলতি পথের কিছু “এলোমেলো ভাবনা।”
আমিনুল ইসলাম