আজকাল তো দেখি কত লোকই (gender independent) ভুলভাল ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছেন, কোন ধারণা উপলব্ধি ছাড়াই টিভিতে চলে যাচ্ছেন , বক্তৃতা টক্তৃতা দিচ্ছেন । এজেন্ডা হল সনাতন ধর্মকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে মিশ্রন থাকবে না , অন্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ থাকবে না । বিশ্বাস করুন এদের দেখলে সত্যিই করুণা হয় । আপনি পাল্টা প্রশ্ন করলে বা বিতর্কে গেলে আপনাকে মাকু , RADICAL LEFT দেগে দিয়ে এরা পালিয়ে বাঁচে । এদের ধারণা নেই এত নিম্ন জাতীয় interpretation দিয়ে কোন পাল্টা narrative কখনও তৈরি করা যায় না । পোস্টটা মুষ্টিমেয় দুই এক জনের বিরুদ্ধে । কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে একেবারেই নয় ।
একটা জাতির বিগত কয়েক দশক ধরে চলা খাদ্যাভাস , রন্ধন শৈলী, ছুতমার্গিতা , লোকাচার , গ্রহণ ও বর্জন সেই জাতির সামাজিক নৃতত্ত্ব কে বোঝায় তেমনি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বোঝার জন্য রয়েছে সঙ্গীত এবং পোশাক-আশাক । পন্ডিতরা সংস্কৃতির নানা বিচিত্র সংজ্ঞা নিরুপম করেছেন । তার মধ্যে একটি হল , ‘ সংস্কৃতি আসলে ‘ man made part of the Universe ‘ অর্থাৎ মহাবিশ্বের স্রষ্টা কে না জানলেও তার যে অংশটি মানুষের সৃষ্ট তাকে বলে সংস্কৃতি । এই সংস্কৃতির যেমন নানারকম চেহারা থাকে , রূপান্তর হয় তেমনি তা পর্যটনশীলও বটে । এই কারনে একে ‘ parambulating culture ’ বলা হয় । খাদ্যাভাস, পোশাক এগুলো সবই সংস্কৃতিরই এক একটি অঙ্গ । ভিন্ন ভিন্ন জাতি , ধর্ম মিলিত হয়েছে । তার ফলে একে অপরের খাদ্য , পোশাক , সংগীত নিজেদের মধ্যে গ্রহন করেছেন । এটা মানবজাতির ইতিহাস ।
মানুষের খাদ্যাভাস কিংবা পাকপ্রণালী কে অস্বীকার করে আপনি কিছুতেই একটি সমাজের পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকতে পারবেন না ,তেমনি সেই খাদ্যাভাস বা পাকপ্রনালী কে অনুধাবন করার জন্য তাকে সমাজ এবং ইতিহাসে আলোতে বোঝার চেষ্টা করতে হবে । উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি ধোকার ডালনার অপূর্ব স্বাদের সঙ্গে আপনাদের অল্পবিস্তর পরিচয় রয়েছে । কিন্তু এর আসল মহিমা আপনারা কখনই অনুধাবন করতে পারবেন না যতক্ষণ না জানবেন এর নামকরণের ইতিহাস । সধবা অবস্থায় আমিষ গ্রহণে অভ্যস্ত বাঙালি স্ত্রীরা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়ার ফলে আমিষ গ্রহণ করতে পারতেন না । সেই অল্প বয়সী বাঙালি হিন্দু বিধবা কুল আমিষ খন্ডের আদলে ডাল বাটার খন্ড বানিয়ে তার নাম দিল ধোঁকা — আমিষ খাবার আত্মপ্রতারণা করা হচ্ছে বলে । এইবার আপনি বুঝতে পারবেন কেন ধোকা রান্নায় গরম মসলা দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে রান্না করা হয় । তেমনি একজন ভিনদেশীও বুঝতে পারবেন উনবিংশ শতকে কৌলিন্য প্রথা , অল্প বয়সী হিন্দু বাঙালি বিধবাদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সামাজিক আঁচটা ।
ইতিহাসের বিচারে কলকাতা ভারতবর্ষের প্রথম কসমোপলিটন শহর । কিন্তু কসমোপলিটন সংস্কৃতির যে মৌলিক চরিত্র , ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিকে অবিকৃতভাবে ধারন করা ও প্রশ্রয় দেওয়া , কলকাতা তা কি কোনদিন সত্যি অর্থে ছিল ? অর্থনীতির মানদণ্ডটা যত দ্রুত কলকাতা থেকে সরে গিয়ে পশ্চিমের দিকে ঘেসেছে, তত একেবারে আংকিক নিয়ম মেনে Authencity নিয়ে কলকাতাবাসীর মাথাব্যথা ততটাই দ্রুত কমেছে । খাদ্যসংস্কৃতির কথাই ধরা যাক । বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতির স্বাদ ও রন্ধনশৈলীর বহমান ধারা হুগলি নদীতে এসে মিশেছে বটে , তবে একটিও তার খাঁটিত্ব কে অবিকৃত রেখে নয় । অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা যত কমবে তত একটি জাতি ‘ মা যা ছিলেন ‘ থেকে ‘ মা যা হইয়াছেন ‘ উপর বেশি আগ্রহ দেখাবে । এই আগ্রাসী আগ্রহ থেকেই বাঙালি কখনো রান্নার সময় বিচার করেনি পটলের দোলমা তে ‘দোলমা’ আসলে গ্রিক না মধ্য এশিয় । কিংবা মালয়েশিয় নাবিকদের হাত ধরে আসা ‘ চিংড়ির মালয়- কারি ‘ কে নিজেদের মত চিংড়ির মালাইকারি বানাতে বাঙালি দুবার ভাবেনি । বাঙালি ফ্রাইড রাইসে কাজু কিসমিস ঢুকিয়েছে , চাউ মিয়েনে আলু । এমনকি চীনে পাড়ার চীনেদের পর্যন্ত বঙ্গ চাইনিজ রান্নায় অভ্যস্ত করিয়েছে ।
নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অনেক সুগম হওয়ার কারণের পাশাপাশি ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা হওয়ার জন্য এখানে ভিনদেশিরা এসেছে বেশি । ফলে পশ্চিমবঙ্গে রন্ধনশৈলীতে বহির্বিশ্বের প্রভাব পূর্বের তুলনায় অনেকটা বেশি । পূর্ববঙ্গের পরিবারগুলোতে যখন রান্নাঘর অনেক বেশি ঐতিহ্যবাহী রান্নায় সমৃদ্ধ তখন কলকাতা কালচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি । একটু খেয়াল করলে দেখবেন যেসব রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠা প্রাক স্বাধীনতার যুগের আশেপাশে তাদের প্রায় প্রত্যেকের নামের শেষে ‘ কেবিন’ শব্দ টা জুড়ে আছে । ফ্রেন্ডস কেবিন,বসন্ত কেবিন, দিলখুশা কেবিন, অনাদি কেবিন, স্বাধীনতা কেবিন, নেতাজি কেবিন, বিবেকানন্দ কেবিন, শরৎ কেবিন….. । প্রশ্ন হল রেস্তোরাঁর নামের শেষে কেবিন কেন ? চটপট উত্তর আসবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিভৃত আলাপে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পর্দা দেওয়া কেবিন থাকত তাই । ব্যাপারটা আদপেই তা নয় । অনেক রেস্তোরাঁতে কেবিনে পর্দা থাকত না । পর্দা দেওয়া থাকত মূল দরজায় । কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারগুলোর আমিষলোভী পুরুষকূল কে মুরগির মাংসের আস্বাদন নেওয়ার জন্য এই রেস্তোরাঁগুলো সামাজিক নিরাপত্তার আশ্বাস দিত । কলকাতার খাদ্য-সংস্কৃতি তে এই কেবিনগুলোর ভূমিকা কিন্তু অনস্বীকার্য । এরাই কলকাতার মানুষকে চিনতে শিখিয়েছিল বিলিতি খাবারের স্বাদ , তা সে যতই বাঙালিকরন করা হোক না কেন । আমরা বুঝতেই পারিনি কবে চিকেন কাটলেট উইথ এগ কভারেজ হয়ে গিয়েছে চিকেন কবিরাজি কিংবা ব্রেইজড (মাংস মুড়ে দিয়ে) কাটলেট হয়ে গেছে ব্রেস্ট কাটলেট । আমরা কজনই বা জানি যে ‘চপ’ আসলে মুসলিম খাদ্য-সংস্কৃতির ‘চাব’ থেকে এসেছে । এরকম প্রচুর লেখা যায় । লেখা যায় বিরিয়ানির বাঙালিকরণ নিয়েও । কিছুদিন আগে শুনলাম মালদহ অঞ্চলে স্থানীয় মুসলিমরা একেবারে পাঁচফোরন সর্ষের তেল দিয়ে বিরিয়ানি রাঁধেন । ডালডা কিছুই থাকেনা । মানে সম্পূর্ণ বাঙালিকরন হয়েছে ।
১৪৯৮ সালে ভাস্কো ডা গামা ভারতে এলেও ভারতের গোয়াতে পর্তুগিজ কলোনির পত্তন হয় ১৫১০ সালে ফ্রান্সিস ডি আলবুকার্কের আমলে । গোয়ার পাশাপাশি তারা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে । পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় পৌঁছয় , চট্টগ্রামের একটি ব্যস্ত বন্দরে যার নাম তারা দিয়েছিলো ‘ Porto Grande’ সেটা ১৫১৭ সাল । সেই সময়ই চট্টগ্রামের পাশাপাশি সাতগাঁওতেও স্থাপন করা হয়েছিল দুটো পর্তুগিজ ব্যবসায়িক কেন্দ্র । তখন থেকেই বাংলায় পর্তুগিজদের আনাগোনা, মেলামেশা শুরু । এই দুটো কেন্দ্র ছাড়াও বাংলাতে পর্তুগিজ কলোনি গড়ে উঠেছিল তমলুক, হিজলি, মিরপুর, হুগলি এবং ব্যান্ডেলের আশেপাশে । এগুলো গড়ে ওঠে ১৫৭৯-৮০ সাল নাগাদ । জানা যায় যে ১৬০৩ সাল নাগাদ হুগলিতে প্রায় ৫০০০ পর্তুগীজের বাস ছিল ।
মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই সব অঞ্চলে দ্রুত তৈরি হতে লাগলো মিশনারি চার্চ , হাসপাতাল আর স্কুল যার বেশিরভাগই আজ আর নেই । তবে আজও ” Nossa Senhora do Rosario’ চার্চ সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে । এই Nossa Senhora do Rosario’ চার্চকেই আজ আমরা ব্যান্ডেল চার্চ বলে চিনি । বিভিন্ন খাওয়া দাওয়া আর ভাষার ওপর পর্তুগিজ প্রভাব তখন থেকে শুরু যা আজও বর্তমান ।
বাঙালি জলখাবারে যে খাদ্য বস্তুটি বিরাট জায়গা জুড়ে আছে তা হলো পাউরুটি । এই পাউরুটি প্রথম আসে পর্তুগিজদের হাত ধরে সঙ্গে আসে Yeast । তার আগে আমাদের দেশে দই বা দেশি তাড়ি ব্যবহৃত হতো এই কাজে । পর্তুগিজ ভাষাতে পাও মানে রুটি । এছাড়া আলু জিনিসটিও ভারতে আনে পর্তুগিজরা । এর আগে এদেশে আলুর প্রচলন ছিল না । পর্তুগিজ ভাষাতে আলুকে বলে বাটাটা । টমেটো বলে সব্জিটিও পর্তুগিজদের আমদানি সঙ্গে ছিল কাঁচালঙ্কা । এর আগে এদেশে ঝালের জন্য গোলমরিচ, দারচিনি আর চই ব্যবহৃত হত ।
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম, ভুট্টা সবই পর্তুগিজদের হাত ধরে এসেছে । এছাড়াও এসেছে পেঁপে,আতা পেয়ারা ,আনারস কাজু । বেশ কিছু খাবারের নামেও পর্তুগিজ প্রভাব রয়েছে যেমন কভারেজ কাটলেট থেকে ‘ কবিরাজি কাটলেট বা এগ ডিফিল্ড থেকে ডিমের ডেভিল । প্রতিদিনের ব্যবহৃত সাদা চিনি তৈরিও আমরা শিখেছি পর্তুগিজদের থেকে । আমরা যে ভিন্দালু ( পর্ক, এগ, মাটন )খাই সেটিও পর্তুগিজ রান্না –Carne Vinha de Alhos ।
পর্তুগিজদের তৈরি একটি বিশেষ ছানা এখনো কোলকাতাতে পাওয়া যায় যার ডাকনাম Bandel Cheese । পর্তুগিজ পাদ্রীরা বান্ডেল চার্চে থাকার সময় এই ছানা তৈরি করতো তাদের একান্ত নিজস্ব পদ্ধতিতে । ব্যাপারটা আসলে স্মোকড ছানা –একটু বেশি নোনতা , কলকাতার নিউ মার্কেটের পনিরের দোকান গুলোতে পাওয়া যায় ।
শেষ করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েকটা লাইন দিয়ে :
দিবে আর নিবে , মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।