আপনারা যাহারা বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র করিতে চান তাহারা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে কেন দেখিতে চান না? আপনারা বলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে মত তাহা বাস্তবায়ন করার নাম হইল গণতন্ত্র। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ এই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চলিতে পারেনা। এখানে ইসলামি শাসন চলিবে। তাহা হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে দেখিতে চাওয়াই আপনাদের উচিত। আপনারা যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী, তাই দুনিয়ার কোনো দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকিবে- তাহা আপনারা কিভাবে চাইতে পারেন? সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে সাচ্চা মুসলমান আইএসের হাতে মাইর খাইয়া দলে দলে ইউরোপের যে দেশগুলিতে আশ্রয় লইয়াছেন সেইগুলিতে খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং সেইসব দেশেকে স্যেকুলারিজম পরিহার করিয়া খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হওয়ার দাবি আপনারাই খাস দিলে চাইতে পারেন। মক্কা-মদিনায় অমুসলিম নিষিদ্ধ। একই নিয়মে ভারত, চীন, জাপান এবং ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ঐতিহ্যমন্ডিত সকল অঞ্চলে মুসলমান নিষিদ্ধ করা সমীচীন কি-না?
ইরানে সুন্নি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের যতখানি অধিকার ও মর্যাদা আছে, সৌদি আরবে অমুসলিম এবং শিয়ারা যেমন আছে, আইএস শাসিত অঞ্চলে অমুসলিম এবং নারীরা যেমন অধিকার পাইয়াছিল, তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে অমুসলিম এবং নারীরা যেমন মর্যাদায় ছিল এবং সুলতান সুলেমানদের ইসলামী শাসনে দাসদাসী-নারী-অমুসলিমরা যেমন ছিল, অমুসলিম রাষ্ট্রে মুসলমানদের তেমনটাই প্রাপ্য কি-না? ধরুণ ব্রিটেনকে খ্রিষ্টান ধর্মের দেশ ঘোষণা করিয়া লন্ডনে বসবাসরত মুসলমানদের সৌদি-ইরান স্টাইলের সংখ্যালঘু অধিকার দেওয়া হইল। এই দাবি করিবেন কি-না? কারণ আপনারা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। ধরুন, অমুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের গণিমতের মাল হিসাবে বিবেচনা করিতে শুরু করিল। একজন মুসলমান হিসাবে আপনিতো ইহার বিরোধিতা করিতে পারেন না। হাজার হউক কোরানের বিধান। বিরোধিতা করিবেন কিভাবে?
দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে আমি ভারতের বিরুদ্ধে কেন কিছুই লেখিলাম না -এই বিষয়ে আমার কাছে অনেকেই প্রশ্ন করিয়াছেন। উপরের কথাগুলো তাহারই জবাব। একজন মুসলমান হিসাবে আমি সাম্প্রদায়িকতা অথবা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করিতে পারিনা। তাহাতে মুসলমানিত্বই শেষ হইয়া যাইবে। একজন মুসলমান হিসাবে আমি ইসলামি হুকুম আকামের বিরোধিতা করিতে পারিনা। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মত কুফরি মতবাদের পক্ষে আমার লেখা উচিত নহে। তদুপরি, মানবিক কারণে (মুসলমান হইলেও মানুষতো!) অনেকবার লেখিবার তাগিদ বোধ করিয়াছি। আবার মুসলিম চেতনায় থামিয়া গিয়াছি। হেফাজত এবং জামাত যখন ভারতের সাম্প্রদায়িকতার সমালোচনা করে, তখন আমার লেখার হাত আপনাআপনি থামিয়া যায়। আল্লাহু আকবর বলিয়া ব্লগার হত্যার কাহিনী মনে পরে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, ময়দানে সর্বত্র নাস্তিক ব্লগার হত্যাকে সমর্থন করার দৃশ্য মনে পরে। লালন অনুসারী, নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরোহিত, খ্রিষ্টান পাদ্রী এবং সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যার কথাগুলি মনে পরে। কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের প্রাচীণ মন্দিরগুলি পুড়াইয়া দেওয়ার কথা মনে পরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগর এবং রংপুরের পাগলাপীরে প্রকাশ্যে ইসলামী হামলার কথা মনে পরে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লীতে নারকীয় হামলার কথা মনে পরে। আহমাদিয়া মুসলমানদের উপর সহি মুসলমানদের হামলার কথা মনে পরে। কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে সাচ্চা মুসলমান হিসাবে আমাদের চলমান আন্দোলনের কথা মনে পরে। কাজেই একজন মুসলমান হিসাবে আমি আরেক দেশের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করিতে পারিনা। সে অধিকার আমার নাই। নিজে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চাই। তাই আরেক দেশ সাম্প্রদায়িক হইলে বিরোধিতা করিব কেন? একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে বাস করিয়া আরেক দেশের সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করার চাইতে অসততা আর কি হইতে পারে? সাম্প্রদায়িকতা আর হিংসার নারকীয়তাকে আমরা ভালবাসিতে শিখিয়াছি; আমরা তাহাই করিব।
শতবর্ষ পরে যে শিশু এই পৃথিবীতে আসিবে আজই তাহার কাছে ক্ষমা চাইতেছি। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা কর; ক্ষমা করিও। আমরা হিংস্র মরুদস্যুর উত্তরাধিকারী। আমরা সতীদাহে মানুষ পুড়িয়ে মারার উত্তরাধিকার রক্তে বহন করি। অনাগত সুন্দর পৃথিবী আমাদের ক্ষমা কর।