💰💰আমার অনেক ঋণ আছে 💰
(১৮তম বিসিএস এ আমার চাকরি প্রাপ্তি- রুহুল আমিন এর লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবং নুরুন আক্তারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লেখা)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
“Profession by choice, not by chance” অনেক বন্ধুদের গর্বের সাথে উচ্চারণ করতে দেখি। হয়তো গর্ব করার মতো বিষয়ও, তবে আমার বোঝার সামর্থ্য নেই। আমি না বুঝলেই যে সেটা সঠিক না, তাও নয়। তারপরও মনে হয়, পেশা নিয়ে কি সত্যিই গর্ব করার মত কিছু আছে? আসলেই গর্ব করার মতো কিছু কি করতে পেরেছি এই পেশার মাধ্যমে?
জীবনে যা চেয়েছি, তা কি বুঝে শুনেই চেয়েছি? যা করতে চেয়েছি, তার কতটুকুই বা করতে পেরেছি? এখনো তো প্রতিদিন ভাবি এক, হয় আরেক। পেশা তো শুধুমাত্র জীবিকা অর্জনের একটি উপায় মাত্র। পেশা দিয়ে কি মানুষকে মাপা যায়? আমি যদি এই পেশায় না আসতাম, তাহলে কি আমার জীবন ব্যর্থ হতো? যারা অন্য কাজ করেন, তারা কি আমার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? কম মর্যাদাপূর্ণ? কাজী নজরুল ইসলাম যে ব্যাটেলিয়ানে হাবিলদার ছিলেন তার কমান্ডিং অফিসার কে ছিলেন, জানেন কেউ? আব্বাসউদ্দীন রাইটার্স বিল্ডিং এর কেরানি ছিলেন, ওই ডিপার্টমেন্টর সচিবের নাম কারো জানা আছে?
মাঝে মাঝে সবকিছুই কেমন যেন রহস্যময় লাগে। কোন অদৃশ্য সুতার নিয়ন্ত্রণ নেই তো? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছুই তো অনিশ্চিত! মানি বা না মানি, এক অদৃশ্য সংযোগকে অনুভব করেছি জীবনের বাঁকে বাঁকে। প্রবল ঝড়ে প্রদীপটা যখন নিভু নিভু, ঝড় আরো প্রবল হওয়ার আশঙ্কা, হঠাৎ করে আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝড় থেমে গেছে! কখনো গভীর অন্ধকারে জোনাকিও পথ দেখিয়েছে। তা না হলে আমার তো স্কুল-কলেজের গণ্ডিই পেরোনোর কথা না। বিসিএস এর চাকরি প্রাপ্তির পরতে পরতেও সেই অলৌকিক স্পর্শের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হয়নি।
ক্যাম্পাসে আগের মত আর ভালো লাগেনা। মন খারাপ হয়ে যায়। কেমন যেন বিষন্ন চারিদিক। থিসিসের জন্য রয়ে গেছি। জেনারেল ব্যাচের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে। কলা, বাণিজ্য,আইন অনুষদের বন্ধুরা চলে গেছে আরো আগে। কোন কোন ডিপার্টমেন্টের এক ব্যাচ জুনিয়াররাও ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। ক্যাম্পাস যেন এক ভাঙ্গা হাট! এক সময় যে দিকে তাকাতাম অসংখ্য পরিচিত মুখ, প্রিয় জন। সেই ক্যাম্পাসে এখন নিজেকেই অচেনা মনে হয়! কফি হাউজের আড্ডাটা ভেঙেই গেছে। লিটন(জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন বিভাগ, রাবি), হাসান, জাহাঙ্গীর, উজ্জ্বল, আমি আর কল্লোল-গুটিকয়েক প্রাণী একসঙ্গে থাকি। তারপরও বারোটার আগে হলে ফেরা হয় না। এরপর আরো ২/৪ ঘন্টা আড্ডা। ঘুমাতে ঘুমাতে চারটা, পাঁচটা। সকাল ১০ টা/ ১১ টায় উঠে সিলসিলায় নাস্তা করা। নিরুত্তাপ, শান্ত জীবন।
বিসিএস এর ফরম তোলা, জমা দেওয়া; সবটাই করেছে গৌর। আলাদা কোন প্রস্তুতি ছিল না। কোন গাইড কিনিনি, বিসিএস এর জন্য পড়তেও বসিনি কোনদিন। তবু বিশ্বাস ছিল চাকরি হোক বা না হোক, অন্তত প্রিলি, লিখিত পরীক্ষা এমনিতেই পার হয়ে যাব। সেই পঞ্চম- ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে গোগ্রাসে পড়া অপাঠ্য(!) বইগুলিই সাহস যোগাত । কিন্তু আত্মবিশ্বাসে প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম প্রিলির মাত্র ২ দিন আগে।
এক বড় ভাই হলে এসে উঠলেন। সাথে একাধিক বিসিএস গাইড। প্রচন্ড অধ্যবসাযয়ী, এখানে এসেও বই থেকে মুখ তুলেন না। কিন্তু গভীর সাধনার ফাঁকেও আমাদের বিশৃংখল জীবনযাত্রা তাদের নজর এড়ালো না। “তোমরা বিসিএস দিচ্ছ না?” মাথা চুলকে বললাম, “দাদা, আবেদন তো করেছি।” “পড়াশোনা করো না, রুমে কোন বই পর্যন্ত নাই, বিসিএস কি ছেলেখেলা নাকি?” হয়ে যাবে একভাবে-আমার উত্তর। হো হো করে হাসলেন, এতই সহজ? এরপর তার কথামতো গাইড থেকে তাকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। ছিলেন গণিতের ছাত্র কিন্তু অবলীলায় বাংলা-ইংরেজি- ইতিহাস- উদ্ভিদ বিজ্ঞান -প্রাণী বিজ্ঞান -রসায়নবিজ্ঞান সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন। প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক নামেও এতকটু ভুল করলেন না। পুরো গাইড মুখস্থ! আমি বিস্ময়ে হতবাক! এর ৫% বিদ্যাও আমার নেই। দাদার এই নিয়ে তৃতীয়বার। তারপরেও তিনি আত্মবিশ্বাসী নন। বিসিএস এতই কঠিন! দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আমার জন্মগত, সেটা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার ক্ষেত্রে হলেও। সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আর না। পড়াশোনা করে পরের বার দেখবো।
প্রিলি পরীক্ষা ছিল সম্ভবত বিকাল ৩ টায়। দুপুরে রাজশাহী কলেজের জুনিয়র একটা গ্রুপ সহ লাঞ্চ করছি সাহেব বাজারের জোনাকিতে (অনেকটা ঢাকার নিরব এর মতই)। হবু আমলাদের ভিড়ে জায়গা পাওয়া কঠিন। টলিন (মাহবুবা সুলতানা, জয়পুরহাট) বলল, দাদা তোরও তো পরীক্ষা? “এবার দেবনা, সাথে এডমিটও নেই”। কোন যুক্তিতে কাজ হলোনা। কোন আপত্তিই টিকলো না। আমাকে ওর বন্ধুদের সাথে রাজশাহী কলেজের হোস্টেলে বসিয়ে রেখে ক্যাম্পাসে যেয়ে আমার রুম থেকে প্রবেশপত্র নিয়ে আসলো। পরীক্ষার হলে ঢুকলাম, ততক্ষনে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
সেদিনও নিয়ম ভাঙিনি। হলে ফিরেছি যথারীতি রাত বারোটার পর। আবার দাদার কবলে পড়লাম। দাদা কে ঘিরে ছোটখাটো একটি জটলা। রীতিমত গবেষণা চলছে প্রশ্নপত্র নিয়ে। যাকে পাচ্ছেন তাকে নিয়েই বসছেন। এ পর্যন্ত হয়তো কয়েকশো বার পর্যালোচনা হয়েছে। পরীক্ষা দিয়েছো? মাথা নাড়লাম। পরীক্ষার পর কয়টা পারলাম, না পারলাম -এটা দেখা আমার ধাতে নেই । প্রশ্নপত্রও রাখি না, ফেলে দিই। শাহ আব্দুল করিমের “যা হওয়ার তা হয়ে গেছে” নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু দাদা নাছোড়বান্দা। তাকে ভোলানো গেল না কিছুতেই। নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর দাদা ঘোষণা দিলেন, “তোমার ৭২ টা হয়েছে।”
আমার বিশ্বাস ছিল দাদার কোন ভুল হয়নি, ১০০ টাই হয়েছে। তাই প্রিলির রেজাল্টে দাদার রোল নাম্বার না পেয়ে হতভম্ব হয়ে যাই। বিসিএস গাইড এবং এটিদেবের ডিকশনারি মুখস্থ এরকম বহু মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে এই পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সুমি ভাইয়ের সাথে রুমে যেয়ে সত্যি সত্যি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমার ঠিকানা লেখা পিএসসির খাম। জয়দেব ভদ্র, পিতা: অমর কৃষ্ণ ভদ্র, গ্রাম +ডাক- মাহমুদকাটী, পাইকগাছা, খুলনা। রোল নম্বর-৭৮৩৮১। চূড়ান্তভাবে পুলিশ ক্যাডারে নির্বাচিত। স্বাস্থ্য পরীক্ষার চিঠি। মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। বাবা আমার বাল্যবন্ধু আশীষকে দিয়ে পাঠিয়েছেন চিঠিটা।
আনন্দ, অবিশ্বাস, বিস্ময় সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক অনুভূতি! কিভাবে সম্ভব! ৩ মাস আগে কয়েকজন মিলেই তো ১০৮টা নীল পদ্ম খোঁজার মতো তন্ন তন্ন করে রোল নাম্বার খুজলাম! এখন কোথা থেকে আসলো এই চিঠি? ভয়াবহ বন্যার মধ্যে কিভাবে ডাক বিভাগ এই চিঠি পাঠালো সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে! কোনভাবে যদি মিস হত!
আজ আমি কার কাছে ঋণ স্বীকার করব? গৌর এর কাছে? টলিনের কাছে? লায়নের কাছে? হাসানের কাছে? সুমি ভাইয়ের কাছে? সেইসব শিক্ষকদের কাছে, যারা প্রথম, দ্বিতীয় বর্ষে ফাস্ট প্রথম হওয়া ছাত্রটিকে ফেল করানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন (তারা এটা না করলে হয়তো আমার পেশাগত পরিচয় ভিন্ন হত)। নাকি ডাক বিভাগের কাছে?
নির্ঘুম একটা রাত কাটালাম। কত স্মৃতি! দৃশ্যের পর দৃশ্য সিনেমার মতো ভেসে উঠল মনের ক্যানভাসে! বেশিরভাগই দারিদ্র্যক্লিষ্ট একটি প্রান্তিক পরিবারের দীর্ঘ, ক্লান্তিকর জীবন সংগ্রামের ।
সকালে বাড়ি রওনা দিলাম। ছোটবেলা থেকেই পা ছুঁয়ে আমি কাউকে প্রণাম করি না। বাবা- মাকেও শেষ কবে প্রণাম করেছি মনে নেই। কিন্তু আজ আমার জনম দুখিনী মা এবং নিঃসঙ্গ শেরপার মতো লড়াই করে যাওয়া বাবাকে দেখার জন্য মনটা হু হু করতে লাগলো। একবার তাদের প্রণাম করতেই হবে।
(সমাপ্ত)
জয়দেব কুমার ভদ্র
এডিশনাল ডিআইজি, সিলেট