💰আমার অনেক ঋণ আছে!💰
(১৮তম বিসিএস এ আমার চাকরি প্রাপ্তি- রুহুল আমিন এর লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবং নুরুন আক্তারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লেখা)
দিন তারিখ সঠিক মনে নেই।১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেই হবে। রাত দশটার দিকে ফিরেছি সাময়িক আবাস শহীদ স্মৃতি হল, বুয়েটে। ক্যান্টিন এর কাছে সুমি ভাইয়ের সাথে দেখা। চলো চা খাই। সুমি ভাইয়ের মুখের স্বভাবসুলভ চাপা হাসি। তবে আজ আরও উজ্জ্বল মনে হচ্ছে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার একটা ভালো খবর আছে।” আমি বললাম, বাসা পাওয়ার খবর? না, চাকরির। “চাকরির? কোন চাকরির পরীক্ষাই তো দেইনি!” আমার অবাক হওয়ার পালা। “পরীক্ষা তো দিয়েছিলে, ১৮ তম বিসিএস এর ভাইবা দিয়েছিলে না? সেটাতেই চাকরি হয়েছে।” “ফাইজলামি বাদ দেন মিয়া, বিসিএস এর রেজাল্ট হয়েছে মাস তিনেক আগে, জুনের ২৯ কি ৩০ তারিখে। চাকরি হলে কি টিউশনি করি, না আপনার কাঁধে চেপে থাকি? কোন্ বাসা কনফার্ম হয়েছে বলেন, আজিমপুর না নিউ পল্টন লাইন?
সত্যিই জয়দেব, তোমার ১৮ তম বিসিএস-এ চাকরি হয়েছে, পুলিশে। চলো রুমে। নিজেই দেখতে পাবে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তিনি যে ফাইজলামি করছেন না, তা নিশ্চিত বোঝা যায়। তাছাড়া ফাইজলামি তার চরিত্রের সাথেও যায় না। “রুমে কি পিএসসির চেয়ারম্যান বসে আছেন? আমি গেলে বলবেন, তোমাকে চাকরি দিলাম ১৮তম বিসিএস-এ।” স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি সুমি ভাইয়ের।
ছোটবেলা থেকেই ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেই মানুষ। আবাল্য আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছে । প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকরাও জীবনী শক্তির পরীক্ষা কম নেননি। অন্যরাও সুযোগ নিয়েছে তাদের মতো করে। তারপরও দেবদাস না হয়ে জয়দেব রয়ে গেছি! অসংখ্যবার ছাগলে, গরুতে মুড়ে খাওয়ার পরও কিছু কিছু গাছ যেমন টিকে যায়, আমার অবস্থাও ঠিক তেমনি। উজানে নাও বাওয়াই নিয়তি। তাই পশ্চিম আকাশে হঠাৎ করে ধেয়ে আসা কালোমেঘ কিংবা ১০ নম্বর ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপদ সংকেত শরীর- মনে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। শুধু নিরবে চোয়াল দুটো শক্ত হয়, আর একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তৈরি হয় মন। কিন্তু কারো স্নেহ-ভালবাসার ছোঁয়া পেলে ভিতরটা ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও থাকেনা।
এ বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। মানুষের স্বভাব-চরিত্রের অন্তত ৮০ ভাগ আসে বাবা-মার কাছ থেকে। পরিবার- সমাজ- শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান মিলে বাকি ২০ ভাগ। বাবা ছিলেন দুঃসাহসী, ক্ষেত্রবিশেষে অপরিণামদর্শী। বাঁশের লাঠি নিয়ে কামানের মোকাবেলা করতে তার বুক কাঁপত না। তাই হয়তো শত্রুতা- উপেক্ষা- অবজ্ঞা- দুঃসময়কে খুব চেনা, আপনজন বলেই মনে হয়েছে সব সময়।
“রুমে চলো, রুমে গেলেই তোমার বিশ্বাস হবে।” বলে কি লোকটা! কিভাবে সম্ভব! জুনের দিকে আমরা কলাবাগানে বশির উদ্দিন রোডের একটা বাসায় থাকতাম। আমি ছাড়া বন্ধুরা সবাই উত্তরবঙ্গের। ওরা কলেজ জীবন থেকেই বন্ধু, কারমাইকেলের এইচএসসি সকলেই। বিসিএস এর চূড়ান্ত রেজাল্ট হওয়ার খবর পেয়ে রাত ১ টায় কলাবাগান মোড় থেকে সবাই মিলে ইত্তেফাক কিনে আনি। লায়নের (এরশাদুল হক, যুগ্ম সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) রোল নম্বর পাওয়া গেল। এডমিনে হয়েছে। আমারটা পেলাম না। বিচার ক্যাডারের রেজাল্ট আগেই হয়েছিল, সেখানে মাহবুবের(নির্বাচন কমিশনের কর্মরত) হয়েছে। লায়ন, শহীদ, শাজাহান, নওশাদ- ওরাও দেখল। আমার রোল নাম্বার, বন্ধুদের আরো দু চারটে রোল নাম্বার খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। এখন প্রায় তিন মাস পরে এসে সুমি ভাই বলছে আমার চাকরি হয়েছে! ফাইজলামির একটা সীমা থাকা উচিত! জাবেদ হাসান সুমি, বগুড়ার মানুষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বড় ভাই। সত্তিকারের বড় ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের বছরগুলি তার সান্নিধ্য ও সহায়তা ছাড়া চিন্তাও করতে পারিনা, ঢাকায়ও এই দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছেন পরম আনন্দে।
লায়ন বিসিএস রেজাল্টের পর রংপুর চলে যায়। বইপত্রসহ আনুষঙ্গিক যা ছিল আমাকে দিয়ে যায়, যাতে পরবর্তী বিসিএস এর জন্য প্রস্তুত হতে পারি। কাউকে বুঝতে না দিলেও কিছুটা যে আশাহত হইনি, তা নয়। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা ভালো না দিলেও, ভাইভাটা ছিল অসাধারণ!
কিভাবে যেন আলোচনাটা চলে গিয়েছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং বিশ্ব রাজনীতির দিকে। ৩০ মিনিটের উপরে বোর্ডে ছিলাম, এর চেয়ে ভাল ভাইবা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। অনুভূতি ছিল স্টাডি সার্কেলে বক্তৃতা দেওয়ার মতোই।
শাহজাহান, নওশাদ, শহীদ, শামীমদের সাথে ভালই সময় কাটছিল। খাই-দাই, আড্ডা দিই, ফ্লোরে ঘুমাই (বাসায় কোন খাট-চৌকি ছিল না) এত বছর পরে শহীদের প্রেম হয়েছে(সুদর্শন শহীদ যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোন প্রেম করেনি সেটির সাক্ষী আমি নিজেই)। মুমু ইডেনের ছাত্রী। সেই সুবাদে আমরাও মাঝে মাঝে ইডেনের সামনে আড্ডা দিই। সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের বুক কর্ণারে রাবি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলাবাগানের বাসায় ফেরা। বৃহস্পতিবার চলে যাই নারায়ণগঞ্জে হাসানের কাছে। শুক্রবার সারাদিন জমজমাট আড্ডা দিয়ে, তাস খেলে রাতে ফিরে আসি। এই সুখের জীবনে বাধ সাধল ভয়াবহ বন্যা। মিরপুর রোড, পান্থপথ, গ্রীনরোড সহ ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় নৌকা চলে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে নৌকা নিয়ে ভূইয়াপাড়া হাসানের বাড়ি।সেখানে থেকে কখনো নিতাইগঞ্জে কখনো মাসদাইরে হোসেনদের বাসায় বন্ধুদের আড্ডায় যাই নৌকায়। কামরুল, হোসেন, সেলিম, রাশীদ, টিপু, পিন্টু, তাপস, রেশাদ, মোস্তফা, সাইফুল, রবি, নিতাইদা- অন্যরকম ছিল সেইসব আড্ডা। রাজপথে নৌকা ডুবির শিকারও হয়েছি বেশ কয়েকবার। কলাবাগানের বাসায় গলা পানি। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। যে যার মত জায়গা দেখ।
আমি গিয়ে উঠলাম বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হলে। সুমি ভাই এমফিল/ পিএইচডির ছাত্র হিসেবে ওখানে আছেন। টিউশনিতে তখনই ১০ হাজারের উপরে পাই(আমরা বিসিএসের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম ৪৩০০ টাকা স্কেলে)। সময়ের হিসেবে টাকার অংকটা বেশ ভালই। পুরান ঢাকায় শিয়া কমিউনিটিতে পড়াই। বন্ধু আবিদ রিজভী এই সংযোগ ঘটিয়েছে।
পড়াই আর বাসা খুঁজি। দুই তিন রুমের একটি বাসা খুব দরকার। হাসান এবং কল্লোলকে নিয়ে আসব বাসায়। তারপর একসাথে তিনজন মিলে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিব। হাসান(বর্তমানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদে কর্মরত) নারায়ণগঞ্জ থেকে সাত রাস্তায় অফিস করে আর কল্লোল(জামাল আবু নাসের, বর্তমানে এজিএম রূপালী ব্যাংক) আজিজ মার্কেটের উপরে যুবক অফিসে চাকরি করে। বেতন সামান্যই, গাধার খাটুনি। তিনজন যদি একসাথে থেকে পড়তে পারি তাহলে তিনজনেই বিসিএস কোয়ালিফাই করব একসাথে- এ আমার বিশ্বাস।
কিন্তু ব্যাচেলর এর জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া খুব কঠিন। To-let ধরে ধরে যাই, বাড়িওয়ালা প্রথমে আগ্রহ দেখায়, ব্যাচেলার শোনার পরে বলে পরে জানাবে। সুমি ভাইয়ের ঠিকানা দিয়ে চলে আসি। এ কারণে সুমি ভাই যখন বললো ভালো খবর আছে, খুব খুশি হয়েছিলাম। হয়তো কোন বাড়ির মালিক সুসংবাদ রেখে গেছে! (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
জয়দেব কুমার ভদ্র
এডিশনাল ডিআইজি, সিলেট