আমার ইচ্ছে ছিলো ঢাকা কলেজে পড়বো। মা কিছুতেই রাজি না। আমি আর বাবা মিলে মাকে বোঝাই। অতঃপর , উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই ঢাকা কলেজে, (মানবিক বিভাগে ) ।
কলেজে বেতন দেয়া লাগে না। তবে থাকা-খাওয়ার খরচ তো আছে। কখনও ধান-পাট, কখনও বা সুদে ধার করে আমার খরচ দেন আমার বাবা-মা । কোনো কোনো সময় জমি বন্ধক রেখেও টাকা দিতে হয়। এরই মধ্যে আমার কলেজ জীবন শেষ হয় । রেজাল্ট দেখে সবাই বোঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হবে। বাড়িতে গেলে আমি মাকে বোঝাই ইংরেজির প্রফেসর হবো। ইংরেজিতে ভর্তিও হয়ে যাই । ইতোমধ্যে বড় বোন পাস করে স্কুলে মাস্টারি নিয়েছে। স্বামীর ঘর করলেও সংসারে কমবেশি সাহায্য করে।
আমি হলে থাকি , মাঝে মাঝে টিউশনি করি। বাসায় বাসায় কলিং বেল টিপে পরের ছেলে-মেয়েকে পড়াতে কার ভালো লাগে, তবুও করতে হয়।
মাঝে মাঝে টিউশনি ছেড়ে দেই , মাকে চিঠি লিখি । এর-ওর হাত দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা আসে। সঙ্গে মাত্রা টেনে টেনে গোটা হাতে লেখা মায়ের চিঠি ‘টাকার চিন্তা করিও না, ভিটেবাড়ি বিক্রি করে হলেও তোমাকে পড়াব’। আমি আবার টিউশনি খুঁজে নেই। গুলশান-বনানীতে ধনী লোকের বাড়িতে পড়াতে গিয়ে ভাবি আমার নিজের ছেলেমেয়েরাও কি এসব বাড়িতে টিউশনি করবে?
সরকার পতনের দাবিতে হরতাল-অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়, হল ভ্যাকান্ট হয়, সেশন জট, অনার্স পাস হয় না। বন্ধক কিংবা বিক্রি করতে করতে চাষের জমি কমে এসেছে তবুও নিয়মিত বাড়ি থেকে টাকা আসে। পাশের রুমের সিনিয়র ভাই বিসিএস দিয়ে পুলিশের এএসপি পদে নির্বাচিত হয়েছে। হলের সিনিয়র-জুনিয়র সবাই সালাম দেয়, সামনে কিংবা আড়ালে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করে।
এএসপির এত সম্মান, ছেলেটা মনে মনে সংকল্প করে সেও এএসপি হবে। ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার মতোই গোপনে গোপনে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরীক্ষার সার্কুলার হয়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতাও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। ফার্স্ট চয়েজ পুলিশ । চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ পুলিশের চাকরিতে নেই। পুলিশে ঢুকলে গালিগালাজের ট্রেনিং করতে হয়, মানুষ নষ্ট হয়ে যায়।
একমাত্র ছেলের এমন ভবিষ্যৎ মা কিছুতেই মেনে নেবেন না। ছেলের গোঁ সে এএসপি হবে, এবারও সেই সহজ-সরল বাবা এগিয়ে আসেন। একটির পর একটি ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত ফল বের হয়। পিএসসি’র টাঙানো নোটিশ বোর্ডে বান্ধবীসহ আমি নিজের রোল নম্বর খুঁজতে থাকি ।
পুলিশ ক্যাডারেই খোঁজে। নিচের দিক থেকে খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে হতাশা বাড়তে থাকে। এ তো হতেই পারে না, পরীক্ষা অনেক ভালো দিয়েছে। উপরের দিকে প্রথম রোলটা দেখে নার্ভাস হয়ে যাই, ভুল দেখছি না তো? বান্ধবীকে দেখতে বলি , নিজেও পকেট থেকে অ্যাডমিট কার্ড বের করি। না, সত্যিই রোল নম্বর মিলে যাচ্ছে! ছেলেটা প্রথম হয়েছে! পরের দিন বাড়িতে ফিরে যাই। অনেকক্ষণ মায়ের পাশে বসে থাকি। স্বপ্নের চাকরিতে জয়েন করি। দিন, মাস, বছর গড়ায়। ধাপে ধাপে আমার পদ বাড়ে।
সেই আমি এখন পুলিশ বিভাগের উচ্চ পদে। এতগুলো বছর গড়িয়েছে, বদলে গেছে অনেক কিছুই। বাবা গত হয়েছেন, মায়েরও বয়স বেড়েছে, নানা রকম রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। বদলাননি মা। কাজের চাপে বাসায় ফিরতে দেরি হলে মা ঘুমান না, ফোন করে তাড়া দেন। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় মা বলেন, ‘সাবধানে যা, সঙ্গে লোক আছে তো।’
হরতাল হলে মা বলেন, ‘এই গোলমালের মধ্যে অফিসে যাওয়ার দরকার কি।’ আমি হাসি আর মাকে বোঝাই, গোলমালে পুলিশের দায়িত্ব বাড়ে। টিভি খুললেই ছেলেকে দেখা যায়। মা ফোন করেন, ‘তোর মুখটা এত শুকনা কেন?’ খাবার টেবিলে মা বলেন, ‘এত কম খাইলি?’ মায়ের সামনে পড়লেই মা বলেন, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস। তোর কোনো অসুখ-বিসুখ হয় নাই তো?
মাঝে মাঝে নাতি-নাতনিদের ছেলের ছোটবেলার গল্প শোনান। কাছে না থাকলে অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিদিন ফোন করেন, ছেলের শরীরের খবর নেন। মায়ের অবস্থা দেখে মনে হয়, তার সেই ছোট্ট ছেলেটি এখনও সেইটুকু রয়ে গেছে। পৃথিবীর সবকিছু বদলায়, বদলায় না শুধু সন্তানের প্রতি মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই মমতাময়ী মা আমার মা, আমার গর্ভধারিণী মা, পৃথিবীর সব মায়েরই প্রতিচ্ছবি।
– Monirul Islam
Additional commissioner of Bangladesh police
The current Chief of Counter Terrorism and Transnational Crime (CTTC).
(Collected)