আমি অনেকদিন দেশি মুরগীর রান খাই না।

Uncategorized
আমি অনেকদিন দেশি মুরগীর রান খাই না। শেষবার খেয়েছিলাম আজ থেকে ছয় বছর আগে। তারপর আমার বড় মেয়েটা খাওয়া শিখলে, আমার অতি পছন্দের এই পদটি আর খাওয়া হয়নি।
আমি এমনিতেই ভোজন রসিক নই। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার হলো ভাতের সাথে ঝাল ঝাল করে রান্না করা দেশি মুরগীর ঝোল। খুব ছোটবেলা থেকেই বাসায় মুরগী রান্না হলেই আমার জন্য অন্ততঃ একটি রান বরাদ্দ থাকতোই। আব্বা কোনদিন আমাকে মাছের মাথা খেতে দিতেন না। বলতেন, ” মাছের মাথা খাবে মেয়েরা। বিয়ে হয়ে গেলে, শ্বশুরবাড়িতে আর খেতে পাবেনা তাই বাবার বাড়িতে মেয়েদেরই মাথা প্রাপ্য।”
আমি জিজ্ঞেস করতাম, “শ্বশুরবাড়িতে কেন মাছের মাথা পাবেনা আব্বা?”
– শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ী-স্বামী-দেবরের পাতেই বাঙালী মেয়েরা মাছের মাথা তুলে দেয়। তারপর সংসার আলাদা হলে, দেয় ছেলে-মেয়ের প্লেটে। মাছ যত বড়ই হোক মায়ের ভাগে লেজই জোটে।
কন্যাদের প্রতি আব্বার পক্ষপাতিত্বের কারণেই আমার প্লেটে মাছের মাথা উঠতো কম। তবে বোনেরা দয়া করে তাদের অংশ থেকে প্রায়ই ভাগ দিতো বলে অন্তত মাথার স্বাদটি পেয়েছিলাম।
মাছের মাথা না জুটলেও রান জোটার কারণ হলো, সবাই জানতো এটা আমার ভীষণ প্রিয়। সেই থেকে রান আমার ভাগে অবধারিত হয়ে যায়।
আমার মেয়েটা খাওয়া শিখলো। সেও রান খুব পছন্দ করে। ব্যস, মুরগী রান্না হলেই রান তার ভাগে। ছোট মেয়েটা হওয়ার পরে এখন দু’জনের ভাগে দুটো। আমার মেয়েদের অভিযোগ হলো, “ইশ্ কেন যে মুরগীর গরুর মতো চারটি পা হয় না!”
আমি খাবার টেবিলে মুগ্ধ হয়ে বাচ্চাদের খেতে দেখি। তারা অন্যকিছু খেতে চায় না। আমার মতো তাদেরও মুরগীর রানই পছন্দ।
আম্মাকে আমি কখনো মাছের মাথা খেতে দেখিনি। আমরা খুব পিড়াপিড়ি করলে বলতেন, “মাছের মাথায় আমার একটা আঁশটে গন্ধ লাগে। খেতে পারিনা। তোরা কেন তবু বারবার খেতে বলিস!”
আব্বাকে কতবার মুরগীর রান খেতে বলেছি কিন্তু খেতে দেখিনি। তিনি বলতেন, ” দেশি মুরগীর গোশত এমনিতে চেমড়া হয়। টেনে ছেঁড়া যায় না। আমার বয়স হয়েছে। দাঁত দূর্বল। ঐ চেমড়া গোশত খেতে গেলে দাঁতই ভেঙে যাবে। তোমরা খাও। আমরা জীবনে বহু খেয়েছি। তখন তো মুরগীর অভাব ছিলো না। কত বড় বড় মুরগী হতো আমাদের বাড়িতে! এখন তো আর সে ধরণের মুরগী হয়ই না।”
আব্বা-আম্মারা আঁশটে গন্ধের কারণে দুধ খেতে পারেন না, মাছের মাথা খেতে পারেন না, চেমড়ার কারণে গোস্ত খেতে পারেন না, তাদের প্রিয় খাবার ডাউল আর আমাদের ছেড়ে দেওয়া তরকারির বাকি অংশ। কেন যে তারা ভালো ভালো খাবারগুলো অপছন্দ করেন! ভালো খাবারের মজাই তারা শিখলো না।
সেদিন আম্মার কাছে একটা জমির পুরাতন দলিল চাইলাম বিশেষ প্রয়োজনে। আম্মা রুটি বানাচ্ছিলেন। হাতে তখনও আটা লেগে আছে। বললেন, ”স্যুটকেসের মধ্যে আছে বের করে নে।”
আমি কখনো আম্মার স্যুটকেসে হাত দিইনি। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, এই বাড়িতে তার একান্ত ব্যক্তিগত একমাত্র সম্পদ হলো এটি। কখনো এটি কাউকে দেখতে দেননা তিনি। আব্বা আমাদের ছেড়ে গেছেন নয় বছর। তিনি যক্ষের ধনের মতো এই স্যুটকেস আঁকড়ে রাখেন।
আজ সুযোগ পেয়ে মনে মনে আপ্লুত হলাম। আম্মার এই গোপণ স্যুটকেস আমার কাছে “আরব্য রজনীর ইতিহাস” এর সেই চল্লিশ চোরের গুহার মতই রহস্যময়, যেখানে তারা লুট করা মালামাল লুকিয়ে রাখতো। আমি চামড়ার স্যুটকেস খুলেই থরে থরে সাজানো বেশ কয়েকটি ডায়েরী পেলাম।
গোপন জিনিসের প্রতি মানুষের সীমাহীন কৌতুহল। আমারও কৌতুহল হলো। একটা ডায়েরী খুললাম। কয়েক পাতা পড়লাম। প্রতি পাতায় পাতায় আম্মার লেখা আর কাটাকুটি। একপাশে লেখা আয় অন্যপাশে ব্যয়। আয়ের ঘরে লেখা জুয়েলের বাবার বেতন ২৬০০ টাকা। ডিম বিক্রয় ৩০০। সব্জি বিক্রয় ২০০।
ব্যয়ের ঘরে যা লেখা তাতে খরচ সব সময়ই ৪৮০০। বাজেটে বিস্তর ঘাটতি। ১৭০০ টাকার ঘাটতি পোষাতে আম্মাকে খরচের ঘর বারবার কাটতে হয়েছে। কাটাকাটিগুলো করা হয়েছে আম্মার ঔষধে, আব্বার রিক্সা ভাড়ায়, কেরোসিনের তেলে, মাছ-মাংসে। আমাদের দুধ, ডিম আর টিউশান ফিতে কোথাও কাটা দাগ দেখলাম না, পুরো ডায়েরী খুঁজেও।
আমি স্যুটকেস বন্ধ করলাম। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম আম্মা রুটি বেলছেন। পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরলাম। আমার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছে। আম্মার ঘাড় ভিজে যাচ্ছে। তিনি “কি হয়েছে, কি হয়েছে” বলে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছেন। আমি আরো শক্ত করে তাকে জাপটে ধরছি। তিনি নড়তে পারছেন না। আমাদের টিউশানির টাকা যোগাড় করতে গিয়ে দিনের পর দিন নিজের ঔষধ না খেয়ে দূর্বল থেকে অধিকতর দূর্বল হয়েছেন। তার সাধ্য কি আমার হাত থেকে ছুটতে পারেন!
আমার মেয়ে দুটো হওয়ার পর থেকে আমার পছন্দের মুরগির রান খাওয়া হয়নি। আমি খেয়াল করে দেখলাম, আব্বা-আম্মাকে আমি জীবনেও রান খেতে দেখিনি। পৃথিবীর সব ভালো খাবারে মা-বাবাদের আঁশটে গন্ধ। তারা খেতে পারেন না ওসব অখাদ্য। ধমকে ধমকে ওসব পঁচা খাবার বাচ্চাদের খাওয়ান।
আব্বা নয় বছর আগে চলে গেছেন। আমাদের সব পঁচা খাবার খাইয়ে খাইয়ে আর নিজে ভালো ভালো খাবার খেয়ে। আমি তার জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। এখন তো পারিইনা। শুধু গভীর রাতে জায়নামাজে সিজদাবনত হয়ে মহান রবের দরবারে তার শেখানো দোয়া করি- “হে আমার রব, আমার আব্বাকে তুমি তেমন যত্নে রাখো, যেভাবে তিনি আমাদের রেখেছিলেন। হে আমার রব, আমার আম্মাকে তুমি হায়াতে তাইয়্যাবা দান করো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *