আমি কবি হতে চাইনি, ফার্মাসিস্ট হতে চেয়েছিলাম
✔
Pharmacy education in Bangladesh started its journey in 1964 after the establishment of Department of Pharmacy in the University of Dhaka.
The first academic session (1964 -1965) of the department began with 24 students, including 4 female students.
✔
১৯৬৪ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি ( HSC) পাশ করার পর ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে আমি এই ফার্মেসী বিভাগে পড়তে চেয়েছিলাম এবং ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিলাম।
ফার্মেসী বিভাগের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেয়া ভর্তির জন্য নির্বাচিতদের তালিকায় আমার স্থান ছিলো ১১। আমি তো মহা খুশি। এবার আমাকে আর ঠেকায় কে?
আলবার্ট আইনস্টাইনের সূত্র শুদ্ধকরার জন্য বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বসু যেখানে সিদ্ধিলাভ করেছেন– আমি তার সেই বোধিবৃক্ষতলে বসে বিজ্ঞানসাধনায় মগ্ন হবো। কিছু না কিছু সৃষ্টি৷ না করে আমি ছাড়বই না।
কিন্তু বিধি যদি হন বাম পুরে না মনস্কাম। জগন্নাথ হলে ফিরে গিয়ে শুনি– সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে জগন্নাথ হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমি আমার পিসতুতো ভাই পরিমলের রুমে উঠেছিলাম। সে বায়ো কোমেস্ট্রিতে অনার্স পড়তো। ঢাকায় আমার একমাত্র আত্মীয়। পরিমল বিছানা বালিশ বেঁধে হল ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি পরিমলকে বলি, আমি ফার্মেসীতে চান্স পেয়েছি।
পরিমল বলে– চান্স তো আমিও পাইছিলাম। চান্স পাইলেও পড়া হবে না। পড়া যাবে না। আমাদের বাড়িতে চল আমার সঙ্গে। রাতের ট্রেনেই আমি চলে যাবো।
অগত্যা পরিমলের সঙ্গে আমিও গফরগাঁও-এর নিকটবর্তী মশখালী যাবার জন্য তেজগাঁওয়ের পথে পা বাড়াই।
কিছুদিন মশাখালীর নিকটবর্তী লঙ্গাইর গ্রামে পরিমলদের বাড়িতে কাটিয়ে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই।
দাঙ্গার প্রকোপ কিছুটা কমে আসার খবর পেয়ে, আমার পরিবারের অনিচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে আমি বাবার কাছ থেকে ভর্তির টাকা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।
কিন্তু ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নোটিশ বোর্ডে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখতে পাই– আমার নামটি একটি দীর্ঘ লাল কালির টান দিয়ে কাটা।
তখনকার বিভাগীয় প্রধান ডক্টর জব্বার স্যারের সঙ্গে আমি দেখা করি। তিনি আমাকে জানান যে, ভর্তির তারিখ চলে যাওয়ার পর আমার স্থানে অন্য একজনকে ভর্তি করা হয়ে গেছে এবং ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় চলতি শিক্ষাবর্ষে আমাকে আর কিছুতেই নেয়া সম্ভব নয়।
আমি সেদিন কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে অন্ধকার না সর্ষে ফুল দেখেছিলাম — তা আজ আর মনে করতে পারছি না। তবে পরে বুঝেছিলাম–সেদিনই আমার উচ্চাভিলাষী শিক্ষা-জীবনের অনানুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছিলো।
আমার শিক্ষা জীবনের ছন্দপতনে আমি অন্তরে খুবই আহত বোধ করি। বুঝতে পারি এই ছন্দপতনের খাদ থেকে আমার পক্ষে উপরে উঠে আসা আর সম্ভব নাও হতে পারে। আসলে এই ঘটনাটি ছিলো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে আমার পক্ষে আর কী হওয়া সম্ভব– আমি তখন তাই নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ যে এই কার্জন হলেই তাঁর Meaning of Art নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন– তা তখন আমার জানা ছিলো না। পরে জেনেছি।
এখন এই ঘটনাটি নিয়ে ভাবতে বসে, লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন কার্জন হলের সামনের পথটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম।
এবং তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন– দুঃখ করো না বৎস, এই কার্জন হলের পথে ফেলে-যাওয়া আমার পদচিহ্নকে ( ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি) অনুসরণ করো। তুমি কবি হও।
মুখে কিছু না বললেও– আমি মনে মনে বলি– তথাস্তু। তবে তাই হোক গুরুদেব।
✔
২৭ জানুয়ারি ২০২১।
নির্মলেন্দু গুণ