‘আয়না’ কি মাসুদ রানা সিরিজের বই?

Blog Uncategorized
‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন চলে গেলেন। বিভিন্ন বয়সী লেখক পাঠক তাঁদের পাঠের স্মৃতি থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করছেন। আমিও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, কিন্তু সেটার সঙ্গে আমার কোনো পাঠের স্মৃতি যুক্ত নেই। আমার খুব দুর্ভাগ্য যে শৈশবটা আমার কেটেছে আনন্দহীন পাঠে। আমি মাসুদ রানা সিরিজের কোনো বই পড়িনি। তিন গোয়েন্দা পড়িনি। সেবা প্রকাশনীর মাত্র দুটি বই আমি পড়েছি, তাও অনেক পরে। একটির নাম আয়না, অন্যটির নাম মনে নেই। ‘আয়না’ কি মাসুদ রানা সিরিজের বই? তাও জানি না। 
যে বয়সটা মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা বা দুঃসাহসিক অভিযানের বই পড়ার, সেই বয়সে তাহলে আমি পড়েছি কি?
সে সময় প্রচুর হাদিসের বই পড়েছি। আমাদের গ্রামে আহলে হাদিস ও হানাফি মাজহাবের ভেতর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছিল; এখনো আছে। বাড়ির দু’পাশে মসজিদে দেখেছি দু’ভাবে নামাজ পড়তে। একদিকে ঈদের নামাজ ছয় তাকবির, অন্যদিকে বারো তাকবির। একদিকে তারাবি পড়ানো হয় আট রাকাত, অন্যদিকে বিশ রাকাত। একদিকে নামাজের মধ্যে উচ্চস্বরে আমিন না বললে রাগ করে, অন্যদিকে বললে বিরক্ত হয়। একদিকে পায়ে পা স্পর্শ করে নামাজে দাঁড়ায়, অন্যদিকে ফাঁক রেখে। ফলে আমি সহি সিত্তাহ হাদিস ঘেঁটে ঘেঁটে এই বিভেদের রহস্যটা বুঝতে চেষ্টা করেছি সে সময়ে। তখন সবচেয়ে বেশি পড়া হয়েছে বুখারি শরিফ। আর স্কুল সিলেবাসের বাইরে প্রথম সাহিত্যের বই পড়ি ক্লাস সেভেনে উঠে। গল্পগুচ্ছ এবং ফেলুদা সমগ্র একসঙ্গে। গল্পগুচ্ছটা বাড়িতে কীভাবে এল আজও ভেবে পাই না। বড় ভাইবোনদের সাহিত্যের বই পড়তে দেখিনি। তবুও গল্পগুচ্ছটা কিভাবে যেন পেলাম বাড়িতে। দু’ তিনজনের ব্যবহৃত পোশাকের মতো জীর্ণদশা বইটির। আর ফেলুদা সমগ্র এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে না বলে নিয়ে আসি। চুরি বলছি না কারণ পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিয়ে আসি গোপনে। তার মানে বলছি না জীবনে বই চুরি করিনি। দুটো গল্প সংকলন পড়ে দুইরকম মজা পাই। দুটোই সমান ভালো লাগে। এর আগে ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে বড়ভাইয়ের মুখে রলিংসয়ের গল্প ‘মাদার ইন ম্যানভিল’ এবং কোলরিজের কবিতার গদ্যভার্সন ‘রাইম অব এনসিয়েন্ট ম্যারিনার’-এর গল্প শোনা হয়। মূলত সাহিত্যের প্রতি আমার প্রেম জন্মে এই দুটো গল্প থেকে। 

নবম ও দশম শ্রেণিতে আরো কিছু বই পড়ার সুযোগ হয়। মেহেরপুরে ভালো লাইব্রেরি বলতে ছিল ‘দোয়েল বুক হাউস’, ‘বইঘর’ এবং ‘পপি লাইব্রেরি’। সাহিত্যের বই বেশি বিক্রি হতো না, তাই ‘দোয়েল বুক হাউস’ অল্প কিছু বই রাখত। ওখান থেকে গোর্কি এবং পার্ল এস বাকের ‘মা’, ‘প্যারাডাইস লস্ট’, গ্যেটে সমগ্র, ‘আঙ্কল টমস কেবিন’,  ‘আনা কারেনিনা’,  ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’,  ‘কবি’,  ‘আরণ্যক’, ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’, ‘শেষের কবিতা’—এরকম কিছু বই সংগ্রহ করে পড়ি। এর মধ্যে ‘আরণ্যক’, ‘শেষের কবিতা’, গোয়েটের ‘সাফারিংস অব ইয়ং ওয়ের্দার’ এবং গোর্কির ‘মা’ পড়ে দাগিয়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেলি। এসএসসির আগে-পরে প্রবীর ঘোষ, ভবানীপ্রসাদ সাহু, রাসেল, আজাদ—এঁদের বই পড়তে শুরু করি। সিনেমা হলের সামনে থেকে চটি টাইপের বই কিনেও পড়েছি। কিন্তু সেবা প্রকাশনীর কোনো বই আমার পড়া হয়নি। এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কেউ বলেওনি তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যখন জানলাম তখন আর টেবিলজুড়ে অন্য পাঠ। এই না-পড়াটাকে আমি পাঠক হিসেবে আমার অপূর্ণতা মনে করি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, একটা শৈশব আমি নষ্ট করেছি ভুল পাঠে। এখন আর সেটা পূরণ করে নেয়া সম্ভব না। তাই কাজী আনোয়ার হোসেন, আপনি আমার ‘অজানা’ থেকে গেলেন, এই কারণেই আমার আরো বিস্ময় আপনাকে ঘিরে। আপনাকে আবিষ্কার ও উপভোগ করতে না পারার খেদ ও অতৃপ্তি নিয়ে আপনার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *