আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি বিষয়ে রাজীব মালহোত্রার সাক্ষাৎকারের অনুলিখন: (সবার পড়ার প্রয়োজন নেই)
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘মরমিয়া স্পিরিচুয়াল সোসাইটি’র প্রাণপুরুষ শ্রদ্ধেয় জয়দীপ মহারাজ
অনুবাদ- সৃজনা
প্রশ্ন:
এবার আপনার কাছে যে জিজ্ঞাসাটি রাখব সেটি একটু বিতর্কিত, অতিমারীর ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটি’ সম্পর্কে আমি অবগত এবং বর্তমানে আমার মনে হয়েছে সেটি বাস্তবই৷ আমার প্রশ্নটি হল সমগ্র বিশ্ব কি ‘জম্বি কমিউনিজমের’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে? অতিমারীর বিধিনিষেধ, টীকাকরণের সপক্ষে ক্রমাগত প্রচার কি ‘ডীপ স্টেটের’ ‘এক বিশ্ব’,’এক নিয়ম’,’এক জাতি’,’এক ভাষা’র ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করে তুলেছে? ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ কি এ বিষয়ে সাহায্য করছে?
উত্তর:
আর্টিফিশিয়াল ইণ্টেলিজেন্স যেটা করছে সেটাকে আমি বলি ‘মোরনাইজেশন অফ দ্যা মাস’ বা মানুষকে নির্বোধ করে দেওয়ার প্রজেক্ট যাতে সে সব কিছুর জন্য গুগলের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে৷ নেটফ্লিক্স আপনাকে নির্দেশিকা দেবে আপনার কি সিনেমা দেখা উচিত কিংবা ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটের মাধ্যমে আপনার কাকে বিবাহ করা উচিত৷ সুতরাং জনসাধারণের আলগরিদমই নতুন এ.আই৷ আর যেখানে আলগরিদম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মানুষের নিজস্ব স্বাধীন চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে৷ আমি এটাকে তিন নম্বর ব্যাটলগ্রাউণ্ড বলে থাকি, ‘ব্যাটল ফর এজেন্সি’৷ এক্ষেত্রে আমরা স্বাধীন চিন্তাশীলতাকে ত্যাগ করছি এবং কেবলমাত্র এ.আই এর নির্দেশিকা পালন করতে করতে জড়বুদ্ধির ‘জম্বি’তে পরিণত হচ্ছি৷ আর অতিমারীর সময়ে মানুষ অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে, মানুষ তাদের গোপন তথ্য প্রকাশ করেছেন কারণ তাঁরা মনে করেছেন এর মাধ্যমে তাঁরা নিরাপদ হবেন৷ বহু মানুষ রাতারাতি চাকুরী থেকে ছাঁটাই হয়েছেন৷ প্রভাব বেড়েছে এ.আই এর৷ ইলেকট্রনিক অ্যাক্টিভিটি বেড়েছে কারণ এ.আইয়ের মাধ্যমেই সম্ভব ঘরে বসে জনগণের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য সংগ্রহ করা৷ মানুষের গোপনীয়তা থাকছে না যেটা সত্যিই উদ্বেগের৷ যখনই প্রাচীন কোন অর্ডারের অবলুপ্তির সময় আসে, স্বাভাবিক কারণেই তখন টালমাটাল একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়৷ নতুন আরেকটি অর্ডারের জনমানসে গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলতেও যথেষ্ট বেশী সময় লাগে৷ যেমন যত সময় এগিয়ে আসবে পৃথিবী থেকে আমেরিকা এবং চায়নার দাদাগিরির অবসানের তত সম্ভবনা তৈরী হবে৷ সুতরাং পুরাতনের ধ্বংসের মধ্যেই নতুনের সৃজনের বীজ সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে৷ ভারতেরও উচিত রক্ষণশীলতা পরিত্যাগ করে সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী হয়ে ওঠা৷ এ.আই হল বর্তমান বিশ্বের কুরুক্ষেত্র৷ কিন্তু ভারতের অস্ত্রগুলি এখনও প্রাচীন৷ তাই এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে ভারতকেও এ.আইয়ের দক্ষতায় আমেরিকা এবং চায়নার সমকক্ষ হতে হবে৷ আমি এখনও এর উপর নিরলস গবেষণা করে চলেছি৷ সুতরাং শুধু মনে ঈর্ষা নিয়ে দেশে বসে আমেরিকা এবং চায়নার সমালোচনা করলে চলবে না ভারতীয়দের, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে তাদের সমকক্ষ হতে হবে৷ আমার মতে গুগল হল বর্তমান বিশ্বের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি আর জিও হল কোম্পানির নতুন জমিদার৷ ব্রিটিশরা অত্যন্ত চালাক ছিল৷ পরাধীন ভারতে রাজাকে খেতাব দিয়ে হাতির পিঠে বসিয়ে শিকার করতে পাঠাত৷ আর আমরা পরাধীন, অত্যাচারিত, দুর্বল, ক্ষুধার্ত হয়েও বলতাম,
“আহা কি সৌভাগ্য! দেখো আমাদের রাজামশাই হাতির পিঠে চড়ে শিকার করতে যাচ্ছেন৷ দেখ তাঁর রাজকীয় বেশ৷”
ব্রিটিশরা জানত ভারতীয়রা অতি আবেগী, তাই প্রশাসনিক সব ক্ষমতা ছিল তাদের হাতে৷ রাজা ছিল তাদের হাতের পুতুল৷ তাই তারা রাজামশাইকে পুতুল নাচ নাচাত৷ ভারতীয়রা এমনিতেই উৎসবপ্রিয়, তাই যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে মাননীয় অভিভাবক ছিলেন রাজাই৷ কিন্তু ঐ লোকদেখানো সম্মানটুকুই ছিল তাঁর৷ সব ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশদের হাতে৷ আর সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে৷ আজকের রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকালেও আপনি একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি দেখবেন৷ এখনও আসল ক্ষমতা বৈদেশিক শক্তির হাতেই৷ আমি মনে করি যে এটা জাতীয় লজ্জা যে ‘ডি কলোনাইজ’ হওয়ার বদলে আমেরিকার পদলেহন করে আমরা এখনও ‘রি কলোনাইজ’ হতেই পছন্দ করি৷
প্রশ্ন:
দর্শকবন্ধু রাঙ্কা তিশো এই প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছেন যে ভারতের ‘স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম’ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? এটা কি ‘ডিজিটাল কলোনাইজেশন’কে প্রতিরোধ করতে সক্ষম?
উত্তর:
‘স্টার্ট আপ ইকো সিস্টেম’ ক্ষুদ্র স্তরে ক্ষুদ্র উদ্যোগ, তাই যেহেতু এটি বৃহৎ উদ্যোগ নয়, ফলত একা এর পক্ষে অসম্ভব বড় বড় দশটি আমেরিকান অথবা চাইনিজ কোম্পানির একাধিপত্যকে সমূলে উৎপাটন করার৷ যদি আপনি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংক্রান্ত বিশ্বের প্রথম সারির তিরিশটি কোম্পানির নাম নেন, কোন ভারতীয় কোম্পানির নাম সেখানে খুঁজে পাবেন না৷ ভারতীয় যদি কোন কোম্পানীর এক বিলিয়ন ডলারের বাজারদর হয়, তবে বিদেশী কোম্পানির বাজারদর সেখানে ট্রিলিয়ন ডলার৷ আর ঘটনা হল ভারতীয় অনেক স্টার্ট আপ কোম্পানির ক্ষেত্রেও উদ্যোগপতি হিসাবে অনেকক্ষেত্রে আমেরিকান পুঁজিবাদীরা থাকছেন৷ চায়নারও থাকতে পারতেন কিন্তু সৌভাগ্যবশত তারা নেই৷ যদি একশ মিলিয়ন, দুশো মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করার পর কোন স্বাধীন ভারতীয় স্টার্ট আপ কোম্পানির মালিক ব্যবসা বন্ধ করে দিতে চান, তিনি জানেন যে সি.কিউ.কিউ.আই ক্যাপিটাল অথবা আরও বেশী দামে তিনি তাঁর কোম্পানিটিকে অন্য আমেরিকান স্টার্ট আপ কোম্পানির মালিককে বিক্রি করে দিতে পারবেন৷ ষড়যন্ত্রটা এটাই যে যদি কোন বুদ্ধিমান উদ্যোগপতি স্টার্ট আপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে বড়লোক হতে চায়, তাকে বড়লোক হতে দাও৷ মেধাকে যদি কাজে লাগাতে চায়, লাগাতে দাও৷ তারপর টাকার টোপ দাও, নাহলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দাও৷ মোটকথা যেনতেন প্রকারেণ তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটিকে কিনে নাও৷
স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলির এটিই পরিণতি হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে৷ গুগল, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার, অ্যামাজন যেমন ভাবে ডিজিটাল জগতে তাদের একাধিপত্য বজায় রাখতে নতুন কোম্পানিগুলিকে কিনে নেয়, স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলির পরিণতিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাই হবে৷ সুতরাং আমি খুব একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না৷ আরেকটি ব্যাপার হল মাল্টিবিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা স্টার্ট আপ কোম্পানির পক্ষে সম্ভবও নয়৷ জি.পি.টি থ্রি হল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ.আই টেকনোলজি৷ চায়না ‘গুগল ব্রেন’ নামক একটি গুগল প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছে বাজারে এবং বিশ্বের বড় বড় দেশ জি.পি.টি থ্রিকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্ধীতা করছে অথচ ভারতের কোথাও কোন ভূমিকা নেই এখানে৷ নতুন মেশিন লার্নিংয়ের ব্যাপারে দক্ষতা থাকা প্রয়োজন, দক্ষতা থাকা প্রয়োজন প্রযুক্তির ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে পারদর্শিতারও৷ কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে আত্তীকরণ করার প্রচেষ্টা করছে ভারত, স্বল্প বাজেট হলেও ভারত চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এখনও অনেক দূর যেতে হবে৷ কিন্তু যে হারে চীন কিংবা আমেরিকা এগিয়েছে ভারত ঠিক ততটা টক্কর দেবার উপযুক্ত কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে৷
প্রশ্ন:
আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন কিভাবে মানুষ সেই গণজাগরণের সেই পথের শরিক হতে পারেন, কিভাবে যুক্ত হতে পারেন বহু দর্শকবন্ধু জানতে চেয়েছেন এ বিষয়ে?
উত্তর:
যাঁরা গণজাগরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে ইচ্ছুক, তাঁদেরকে বলছি আর্টিফিশিয়াল ইণ্টেলিজেন্সের উপর শেষ ছয়মাসে আমার গবেষণাধর্মী বক্তব্যের প্রায় পঞ্চাশটি ভিডিও আছে৷ দুমাস আগেই আমার একটি জটিল সার্জারী হয়েছে, আমি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম৷ ছাব্বিশ পিস হার্ডওয়্যার আমার পিঠে বসানো হয়, খুবই যন্ত্রণাদায়ক অপারেশন৷ আমাকে বলা হয়েছিল একঘন্টার বেশী বসে না থাকতে৷ কিন্তু আমি কর্মী মানুষ, আমি যন্ত্রণা সহ্য করেও হাসিমুখে সব কাজ করে গেছি৷ আজ সকালে সুদর্শন টিভিতে একটি অনুষ্ঠান ছিল, এখন আপনাদের সাথে অনুষ্ঠান করছি, আগামীকাল স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দীর্ঘ তিনঘন্টার অনুষ্ঠান করব৷ সুতরাং একা আমি আর কত করব৷ আমার দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন৷ অনেকেই আমাকে বলেন, “আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই৷” কিন্তু যদি তাঁরা উচ্চশিক্ষিত না হন, প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ না হন দেখা যাবে তাদের থেকে সাহায্য পাবার পরিবর্তে আমাকেই তাদেরকে সাহায্য করতে হচ্ছে৷ আমার এমন মানুষের প্রয়োজন যাঁরা প্রাপ্তমনষ্ক, যাঁরা পরিশ্রমী, যাঁরা দক্ষ যাতে আমি যখন তাঁদের কোন প্রজেক্ট দেব, তাঁরা যেন সেটা দায়িত্বসহকারে পালন করতে পারে৷ যে রিসার্চ মেটিরিয়াল আমি তাঁদের সরবরাহ করব, তাঁরা যেন সেগুলিতে সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন ভাষায় অ্যানিমেশন, গেমসে রূপান্তরিত করতে পারে, যাতে মানুষ আগ্রহী হয় সেটা বুঝতে৷ যদি বাংলার কেউ সাহায্য করতে চান, তাঁরা আমার সাথে যোগাযোগ করে আমার লেখা বইয়ের বঙ্গানুবাদ করতে পারেন৷ আমার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপর লেখা বইতে পাঁচটি ব্যাটলগ্রাউণ্ড সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ আছে, একটি পরিচ্ছেদের বঙ্গানুবাদ করলে পঞ্চাশ পাতার একটি ছোট বই হবে৷ তাঁরা চাইলে আমার ভিডিওকে ডাবিং করতে পারেন৷ কিন্তু তাঁদের নিষ্ঠাবান হতে হবে৷ আমার পক্ষে সবসময় সম্ভব নয় তাদেরকে মার্গদর্শন করানো৷ তাঁদের নিজেদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে নিজেদের কাজে৷
(চলবে)
Srijana Jhilam