আর বাংলাদেশকে এখনো যে ‘বাঙালির রাষ্ট্র’ বা ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়কে স্রেফ ‘বাঙালির বিজয়’ হিসাবে দেখা হয়, এ নিয়ে নতুন করে আর কি বলার আছে?

Uncategorized
বিজয়ের মাসে ফুটবলের মাঠে পাওয়া বিজয় নিয়ে অনেক মাতামাতি হল,  এবার চলুন এই দেশকে বিজয় এনে দেওয়া অনেকের নাম-পরিচয় – নিদেনপক্ষে তাঁদের নামের বানান – নিয়ে একটু ভাবি!

আমরা জানি, বাংলাদেশকে ‘বাঙালির রাষ্ট্র’ বা ১৬ই ডিসেম্বরকে ‘বাঙালি জাতির বিজয়ের দিন’ হিসাবে দেখার প্রবণতা বদ্ধমূল হয়ে থাকলেও বাস্তবে এদেশে বাঙালি ছাড়াও আরো বহু জাতির বসবাস রয়েছে, আপেক্ষিক বিচারে তাদের জনসংখ্যা যত কমই হয়ে থাকুক না কেন। তো, যাঁরা এই বিষয়টির কথা মনে রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন যে, দু’দিন আগে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া যে নারী ফুটবলাররা এদেশের পতাকাকে উঁচুতে তুলে ধরেছেন, তাঁদের অনেকের পরিচয় ঠিক ‘বাঙালি’ নয়, বরং তাঁরা কেউবা চাকমা (এবার সবার নজরে আসা ঋতুপর্ণাসহ একাধিকজন), কেউবা মারমা (যেমন, ‘মগিনী’ উপাধিধারী দুই বোন), অথবা গারো (অধিনায়ক মারিয়া মান্দা), কিংবা সান্তাল (যেমন, সোহাগী কিসকু)।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, উপরে উল্লেখ করা খেলোয়াড়দের অনেকের নাম পত্রপত্রিকায় নানান বানানে লেখা হয়ে আসছে। যেমন, অধিনায়কের নাম অনেক জায়গায় ‘মারিয়া মান্ডা’ লেখা হয়। কিন্তু গারো জাতির একজন হিসাবে তাঁর নামের বানান ‘মান্দা’ই হওয়ার কথা, যদি না স্কুলে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে এটিকে ‘মান্ডা’ বানানো হয়ে থাকে। যাই হোক, আমার জানামতে ‘মান্ডা’ বানান গারোদের নাম বা তাদের ভাষার বিভিন্ন শব্দ বাংলা হরফে লেখার প্রচলিত রীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। 
এদিকে ‘মগিনী’ নামটা নিয়ে আমি বেশ আগেও যেমন একবার ফেসবুকে লিখেছিলাম, মারমাদের মধ্যে একদা নামের শেষে ‘মগ’ উপাধি লেখার প্রচলন ছিল, বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে, এবং সে অনুযায়ী মারমা নারীদের অনেকে মগের স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে ‘মগিনী’ উপাধি লিখতেন। যাই হোক, আমি ঠিক জানি না আনাই বা আনুচিং-এর নামের বানান স্কুলে বা জাতীয়পরিচয়পত্রে কি বানানে লেখা আছে, তবে পত্রপত্রিকায় ‘মগিনী’ বানানের পাশাপাশি ‘মগিনি’, ‘মোগিনি’ ইত্যাদি অনেকেই লিখে চলছেন! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, যাঁরা জানেন না যে এই উপাধি শুধু মারমা নারীদের বেলায় প্রযোজ্য, তাঁরা অনেকেই ধরেই নিয়েছেন যে আনাই ও আনুচিং-এর বাবার নামের উপাধিও ‘মগিনি’ বা ‘মোগিনি’, তাই তাঁরা মেয়েদের জন্মে শুরুতে হতাশ হওয়া ‘মগিনি দম্পতি’র গল্প লিখে চলছেন! 😀

আর বাংলাদেশকে এখনো যে ‘বাঙালির রাষ্ট্র’ বা ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়কে স্রেফ ‘বাঙালির বিজয়’ হিসাবে দেখা হয়, এ নিয়ে নতুন করে আর কি বলার আছে? যাই হোক, আমার ‘ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ভূমিকায় পাঠকের উদ্দেশ্যে আমার কিছু প্রশ্ন দেওয়া রয়েছে। এসব প্রশ্নের একটা হল, নিচের নামগুলি পাঠক কখনো শুনেছেন কিনা – কা কাৎ হাইনিয়েতা, লতিকা মারাক, প্রিনছা খেঁ, মংপ্রুসাইন চৌধুরি, উ ক্য চিং, নাডা হেমব্রম, গিরীন্দ্র সিংহ, চিত্তরঞ্জন কার্বারি। এঁদের নাম-পরিচয় যদি পাঠকের জানা নাও থাকে, একটু খোঁজখবর নিলেই তাঁরা জেনে যাবেন যে এই তালিকায় সাতটি ভিন্ন জাতির মানুষ রয়েছেন, যাঁরা সবাই একাত্তরেরর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে বীর বিক্রম (উ ক্য চিং) থেকে শহীদ (যেমন নাডা হেমব্রম, গিরীন্দ্র সিংহ, চিত্তরঞ্জন কার্বারি/চাকমা) রয়েছেন, আবার বহুকাল অস্বীকৃতির অন্ধকারে থাকার পর গণমাধ্যমের সুবাদে পরিচিতি পাওয়া ‘কাঁকন বিবি’ নামে অধিকতর পরিচিত হয়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন, যাঁর আদি নাম ছিল কা কাৎ হাইনিয়েতা। যাই হোক, এঁদের কথা যদি আপনি জানেন, বা ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকাকে উঁচুতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মারিয়া মান্দা, আনাই মগিনী, ঋতুপর্ণা চাকমা প্রমুখদের অবদান সম্পর্কে জানেন, তাহলে আপনিও নিশ্চয় এটা মানেন যে, ডিসেম্বরকে স্রেফ ‘বাঙালির বিজয়ের মাস’ বা বাংলাদেশকে ‘বাঙালির রাষ্ট্র’ বলে চলা স্রেফ সংকীর্ণ জাত্যাভিমানপ্রসূত অন্ধতা ও মূঢ়তা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *