শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম’-এর পথ হলাে সুপ্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধ্যাত্ম দর্শনের অন্তর্ভূক্ত যােগশাস্ত্রের একটি বিশেষ পথ। যাকে হঠযােগ বলা হয়। দেহকে গঠন করে, তাকে রােগমুক্ত করে, দীর্ঘায়ু করে তবেই যােগের কঠিন সাধনায় এগুতে হবে। নইলে ভঙ্গিল দেহ অসুস্থ কায়াযােগের নিত্য নতুন সম্পদ গ্রহণে সমর্থ হবে না। যােগফল লাভের পূর্বেই সে-দেহ বিনষ্ট হয়ে পড়বে। প্রাচীন যােগশাস্ত্রের সামগ্রিক ভাবনার এবং পরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট অংশ হলাে এই হঠযােগ।।
ইয়ােগা’কে খণ্ডিত অর্থে শুধুমাত্র যােগ-ব্যায়াম না বলে একটি অতি বাস্তব ও প্রায়ােগিক দর্শন হিসেবে দেখাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। যােগব্যায়াম হচ্ছে তার একটা অংশ মাত্র। তাই বলা যায়, সব যােগ-ব্যায়ামই মূলত ইয়ােগা, কিন্তু ইয়ােগা মাত্রেই যােগ-ব্যায়াম নয়, আরাে বেশি কিছু। যদিও এই সমৃদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি ও লালন-পালন প্রাচীন ভারতেই, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এসে এর ব্যাপক চর্চা এখন ছড়িয়ে গেছে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গােটা মানববিশ্বে। পার্থক্য কেবল এর আধ্যাত্মিক বীক্ষণের রূপান্তরটুকুতেই। যা বহুবিধ ধারায় বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সূত্র সমন্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পারফরমিং আর্ট বা মনােবীক্ষণিক পদ্ধতি হিসেবে একই সাথে অধ্যয়ন ও জনপ্রিয় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। জুডাে, ক্যারাটে, সু, জুজুৎসু, কুংফু ইত্যাদি মার্শাল আর্ট বা সম্মােহন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন, হিলিং, কোয়ান্টাম ম্যাথড, যােগব্যায়াম ইত্যাদি ইত্যাদি আরাে কতাে কী পােশাকী নাম! মােদ্দা কথা এই সবগুলােরই চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মন নামক এক অদৃশ্য চেতনাগত অবস্থার অভাবনীয় ক্ষমতার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে দৃশ্যমান মাধ্যম এই দেহটাকে ইচ্ছেখুশি আজ্ঞাবাহী করে তােলার অভূতপূর্ব অবস্থায় উন্নীত করা। আর তাই যন্ত্রসভ্যতার এক বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশকালের গণ্ডিহারা বিচ্যুত ও একাকী হয়ে যাওয়া মানবসত্তার কাছে হাজার বছরের পুরনাে ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন আজ কার্যকর এক প্রায়ােগিক দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে গােটা বিশ্বে দিনকে দিন অত্যন্ত আগ্রহের ও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
এতােই যখন অবস্থা, তখন প্রশ্ন আসে, তাহলে এই ইয়োগা আসলে কী? কী এর রহস্য? এবং এর উৎসই বা কোথায়?
‘ইয়ােগা’ (Yoga) মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় ‘যােগ। যার অর্থ গ্রন্থিভূক্ত করা বা সমন্বয় সাধন করা। কীসের সমন্বয় সাধন? হটযােগ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেহযন্ত্রগুলাের কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে মনােদৈহিক সম্পর্কসূত্রগুলােকে প্রকৃতিগতভাবেই একত্যুি করা। এর মৌলিক ধারণা হচ্ছে শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধন’। শুরুতেই যা উল্লেখ করা হয়েছে। হঠযােগ’ হঠাৎ কোন আবিষ্কার বা অভ্যাসশ্রুতি নয় । প্রাচীন মুনি ঋষিরা যােগীশ্বর মহাদেবকে হঠযােগের ৮৪০০০ আসনের প্রকাশক বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর ধ্যানে এই দুঃসাধ্য সাধনায় আত্মনিয়ােগ করতেন।

অনুমিত ৫০০০ বছরেরও পূর্বে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতায় বা তারও আগে থেকে ইয়ােগার অস্তিত্ব যে ছিলাে তা প্রাপ্ত ইয়ােগা-আসনের প্রত্ন-নিদর্শন থেকেই ধারণা করা হয়। এছাড়া প্রাচীন গ্রন্থ। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার মতাে শাস্ত্রীয় পুরাণগুলােতেও এর বহু উল্লেখ রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট সময়কাল চিহ্নিত করা না গেলেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৯ শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্ট শতকের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ভারতীয় আর্যঋষি পতঞ্জলিকে আধুনিক যােগশাস্ত্রের জনক বলে ধরা হয়। একটি আদর্শ . নৈতিক জীবন যাপন চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধানের নিহিত লক্ষ্য অর্জনে The Yoga Sutra of Patanjali বা যােগসূত্রের ১৯৫ টি সূত্র সংকলনের মাধ্যমে তিনি যােগশাস্ত্র সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান পরিকল্পনা ও যাবতীয় ভাবনাগুলােকে কতকগুলাে আবশ্যকীয় নীতিমালা বা গাইড লাইন আকারে প্রকাশ করেন। এগুলােই যােগসাধনার মৌলিক উৎস হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। যাকে পতঞ্জলি লক্ষ্যনিহিত সুষ্ঠু জীবন যাপন পদ্ধতির নিয়মাবলী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তাঁর মতে ইয়ােগা বা যােগসাধনা প্রচলিত বা উদ্দেশ্যহীন জাগতিক কর্মপ্রবাহে নিজেকে নিয়ােজিত করতে প্রয়ােজনীয় সামর্থ অর্জনের লক্ষ্যে গুরুগৃহে শুধুমাত্র কিছুক্ষণ আসন বা শরীরচর্চা করা নয়। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ইয়ােগা হচ্ছে নিহিত লক্ষ্য নিয়ে দেহ মন ও আত্মশক্তিকে উৎকর্ষতায় উন্নীত করার একটি কার্যকর মাধ্যম। পতঞ্জলি এই যােগসাধনাকে আবার আটটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেগুলােকে প্রাথমিক অবস্থায় পর্যায়ক্রমিক অনুশীলন এবং সাফল্য অর্জিত হলে পরে সমন্বিত চর্চার মাধ্যমে একটি উন্নত জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানাে সম্ভব বলে তিনি প্রস্তাব করেন। এই আটটি পর্যায়কে The eight limbs of Patanjali বা ‘পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যােগ’ বলা হয়। ত্বরিৎ ফলপ্রাপ্তির তাড়াহুড়াে পদ্ধতি এগুলাে নয়। নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ও দুঃসাধ্য অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই তা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হয়।
পতঞ্জলির অষ্ট যােগাঙ্গগুলাে হচ্ছে-যম (Yama), নিয়ম (Niyama), আসন (Asana), প্রাণায়াম (Pranayama), প্রত্যাহার (Pratyahara), ধারণ (Dharana), ধ্যান (Dhyana) ও সমাধি (Samadhi)।
পতঞ্জলির এই অষ্টাঙ্গ-যােগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শরীর ও মনের গূঢ় সম্পর্ক সূত্রগুলাে। এবং তার উপর ভিত্তি করেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ নির্ভর মনােদৈহিক সম্পর্ক বিশ্লেষণী ইয়ােগা সেন্টারগুলাে বহু বিচিত্র পদ্ধতি ও নামে দেহমনের প্রাকৃতিক চিকিৎসার মাধ্যমে এক স্পিরিচুয়াল আন্দোলনে সুস্থ থাকার প্রতিযােগিতায় নিজেদেরকে ব্যাপৃত করার চেষ্টা করছে।
যেহেতু দেহের সাথে মনের সম্পর্কসূত্রগুলােকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই আজ, তাই সুদেহী মনের খোঁজে পরম সুস্থ থাকার অদম্য ইচ্ছেকে শতবায়িত করতে ইয়ােগা চর্চায় নিজেকে নিয়ােজিত করার আগে পতঞ্জলির
-যােগগুলাে সম্পর্কে প্রাথমিক একটু ধারণা নিয়ে রাখা ইয়ােগাচর্চার জন্যই সুবিধাজনক হবে বলে মনে করি।