এই লেখাটা শরিয়তপুরের জেলা প্রশাসক জনাব পারভেজ হাসানের। অাগ্রহীদের পড়তে অনুরোধ করছি।

Uncategorized

এই লেখাটা শরিয়তপুরের জেলা প্রশাসক জনাব পারভেজ হাসানের। অাগ্রহীদের পড়তে অনুরোধ করছি।
—————————————————————-
আমার আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোন কিছুই খুঁজে পাই না-চমকপ্রদ, অসাধারন ; যা বললেই সবাই অবাক হয়ে যাবে। কিছুই এমন নেই। কিছুই না !
তিনি একজন কৃষকের ছেলে। প্রতিদিন লুঙ্গি কাছা মেরে প্রায় তিন মাইল কাঁদায় হেটে স্কুলে পৌছেছেন। স্কুলের পাশের পুকুরে হাঁটু অবধি লেগে থাকা কাঁদা পরিস্কার করে বাজারের থলেতে থাকা পাজামাটি পায়ে গলিয়ে তাঁর অসম বয়সী বন্ধুদের সাথে ক্লাসে এসে বসেছেন। এই করতে করতে একদিন ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করেছেন। পরীক্ষায় রচনা লিখতে এসেছিল – “ A Rickshaw Puller” । সকালে ধানের ক্ষেতে পাতো (বীজ) রোপন করে পরীক্ষার হলে বসা আমার আব্বু, যিনি ঐ পর্যন্ত নিজ চোখে রিকসা দেখেননি ; তিনি ক্যামনে ঐ রচনাটি লিখেছিলেন, আমাকে বলে যাননি।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. করেছিলেন। ইংরেজীতে লেখা আব্বুর সেই সময়ের নোট আমি দেখেছি। কিন্তু আমাকে ইংরেজী পড়াতে বসলে আমি তাঁকে মানতে চাইতাম না। বার বার বুঝাতে চাইতাম আমার স্কুলের শিক্ষক যে ভাবে পড়িয়েছেন সেটাই ঠিক, আপনার টা মানি না।
আমার আব্বু রসিকতা করতে জানতেন না। বাগেরহাটে তাঁর ছোটবেলায় কোন এক ‘সুচিত্রা’ সেলুনে ‘উত্তম’ রুপে চুল কাটা হয়- এ কথা লেখা দেখে তিনি যে মজা পেয়েছিলেন, সেটিই আমাদেরকে বার বার বলতেন আর মৃদু হাসার ভঙ্গি করতেন। একদিন মজা করে আমাকে জিঙ্গাসা করেছিলেন, বলো তো এর মানে কি- “ I saw a saw to saw a  saw.” আমি বলতে পারিনি, মজাটাও ধরতে পারিনি।
তিনি একটি সরকারি চাকরী করতেন। অবসর গ্রহণের কিছুদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমাকে হলুদ খামের মধ্যে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন “আমি অবসরে যাচ্ছি. এখন থেকে মাসে মাসে তোমাকে খরচের টাকা পাঠানো আমার জন্য অসম্ভব হবে। তুমি একটু কস্ট করে টিউসনি শুরু করো।” তীব্র এক অভিমানে আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল।
তিনি দুটি প্যান্ট আর দুটি জামা দিয়ে বছর কাটিয়ে দিতে পারতেন। ইদে অনেক পুরোনো কাবলী সেট নামক পাজামা-পাঞ্জাবি ধুয়ে ইস্ত্রী করে নতুন  বানিয়ে ফেলতেন। নামাজে বের হওয়ার সময় আমাদের হাতে গুঁজে দিতেন দুই টাকার নতুন কিছু নোট, অভাবি মানুষকে দেয়ার জন্য। তিনি আমাদের কখনো ইদ সেলামি দেননি। এ রেওয়াজ ছিল না।
আব্বু যে আছেন সেটিই আমরা টের পেতাম না। কেমন যেন আলগোছে জীবনটাকে ধরে রেখে চালিয়ে নিয়েছেন। নিজ জীবনে তিনি খুব কমই সারপ্রাইজ্ড হয়েছেন। একবার আমার বৃত্তি প্রাপ্তির সংবাদটি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘কৃতি ছাত্র’ শিরোনামে ছাপিয়ে পত্রিকার কপিটি আমার টেবিলে রেখে যেন কিছুই হয়নি ভঙ্গিতে চলে গেলেন । আমি এমন সারপ্রাইজ্ড আর কখনো হইনি।
আব্বু যেদিন চলে গেলেন, ২০১৮ সালের ১৪ মে দিবাগত রাত, আমি তাঁর হাত দু’টি ধরে চিৎকার করে দোয়া পড়েছি। সে হাতের স্পর্শ আমি আজও টের পাই, প্রতিক্ষণে ; আমার হাতুর তালুতে ।
১৯৮৬ সাল। আমি মো: পারভেজ হাসান, পঞ্চম শ্রেণী, খোকসা-জানিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপজেলা পরিষদের বাসভবনের পিছনে পড়ে থাকা একটুকরো জমিতে বেগুন, আলু, টমোটো ক্ষেতে পানি ঢালছি আব্বুকে সাথে নিয়ে। ২০২০ সাল, জেলা প্রশাসক, শরীয়তপুরের বাংলোর সবজী ক্ষেতে আনন্দ লেগেছে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন, আব্বু ? কী দেখতে পাচ্ছেন ??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *