ডিসেম্বেরর শুরুর দিনের প্রথম স্ট্যাটাসটা শুরু করতে চাই একাত্তরের এক কিশোরীর গল্প দিয়ে। সালটা ১৯৭১। ঘটনাস্থল কুড়িগ্রাম।
১১ নং সেক্টরের অধীনে কুড়িগ্রামে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একটা ক্যাম্প করেছেন। ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন মুক্তিযোদ্ধা #মুহিব_হাবিলদার। ক্যাম্পের রান্নাবান্নার জন্য একটা সাহসী মেয়ে খুঁজছিলেন। এক কিশোরিকেও বাছাই করলেন তিনি। কিন্তু আপত্তি করলেন মেয়েটার মা।
মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মুহিব তখন ওই কিশোরির মাকে বললেন, আমার নিজের মেয়ের মতো করেই আগলে রাখবে। দেশের জন্য মেয়েটাকে দিয়ে দেন। মা কুলসুম বেওয়া রাজি হলেন। সাথে সাথে লেখা হয়ে গেল নতুন এক ইতিহাস।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মেয়েটা শুরু করলেন রান্না। সেখানেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নানা গল্প শুনতেন। মেয়েটা জেদ ধরলেন তিনিও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করবেন। ওই কিশেরারি সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখালেন। শেখালেন কী করে হানাদারদের বুক বরাবর বুলেট ছুড়তে হয়। মেয়েটাও দারুণ শিখলেন। এর মধ্যেই একদিন তার বীরত্ব পুরো ক্যাম্পে গল্প হয়ে গেল।
সেদিন মধ্য দুপুর। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই খেতে বসেছে৷ কিশোরির দায়িত্ব পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখা। সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলো সেই কিশোরি৷ হঠাৎ দেখল, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে৷ মেয়েটি দ্রুত সবাইকে খবর দিলেন। সবার আগে নিজেই অস্ত্র হাতে নিলেন।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চললো৷ হানাদাররা সেদিন পরাস্ত হলো। অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারামনও একের পর এক হানাদারের বুকে বুলেট ছুড়লেন। এরপর শুরু হলো রোজ নতুন নতুন ঘটনা।
শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়৷ হানাদারদের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে মেয়েটি চলে যেত পাক বাহিনীর শিবিরে৷ কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, কখনো বা কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজে চলে গেছে হানাদার ক্যাম্পের কাছে। চুল এলো করে কখনো বোবা সেজে মেয়েটি আবার কখনো হানাদারের খোঁজে নদী সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন।
আমি জানি না আপনাদের কেমন লাগছে। কিন্তু আমার চোখ ভিজে উঠেছে। এই কিশোরির নামটা জানেন কী? নাম তার তারামন বিবি। সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই দেশে মাত্র দুজন নারী ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছিলেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম আরেকজন আজকের গল্পের তারামন বিবি।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তো “বীর প্রতীক” উপাধি পেল। কিস্তু কোথায় তারামন? ৭৫ এর পট পরিবর্তনে সবাই তো ভুলেই গেল সাহসী মেয়েটাকে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে আর কেউ খোঁজেনি।
তবে ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক #বিমল_কান্তি_দে প্রথম তারামন বিবির সন্ধান পান। তাকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী। স্বাধীনতার ২৪ বছর পর রাষ্ট্র তার হাতে তুলে দেয় বীরত্বের পুরস্কার। অবশ্য ফের তারামন বিবিকে ভুলতে সময় লাগেনি আমাদের। অর্ধাহারে-অনাহারে দুই বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছাড়েন তারামন বিবি।
আমরা যারা এই দেশের ১৭ কোটি মানুষ, তাদের মনে রাখা উচিত এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে তারামন বিবির জন্য। এই দেশটা স্বাধীন হয়েছে নাম না-জানা এমন বীরাঙ্গনাদের জন্য।
আমরা যেন মনে রাখি সেই মুক্তিযোদ্ধার কথা যারা আল্লাহ রাসুলের নাম নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে ইসলাম বা সব ধর্ম থাকবে কিন্তু গোড়ামি থাকবে না।তারা চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক সুন্দর এক বাংলাদেশ যেই বাংলাদেশে দুর্নীতি-লুটপাট থাকবে না। যেই দেশটা আসলেই হবে সোনার বাংলা। আমি রোজ সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যাবো। আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য, আগামীর জন্য।
মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
__কাজী নজরুল ইসলাম
Post Courtesy: Shariful Hasan