একাত্তরের রণাঙ্গনে যোদ্ধাদের কাছে শ্রেষ্ঠ বীরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস বীরবিক্রম। আজ তার ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী।
জগৎজ্যোতি দাস (২৬ এপ্রিল ১৯৪৯ – ১৬ নভেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং তার অবদানের জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে।
জগৎজ্যোতি দাস
জগৎজ্যোতি ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়্ত্বি পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৫ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’। জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধের অন্যতম সঙ্গী আবদুল কাইয়ুমের বয়ানে জানা যায়, দাস পার্টি নামটি জনগনের দেওয়া নাম নয়, দাস পার্টির অফিসিয়াল দলিল ছিল এবং পার্টি কমান্ডার হিসেবে জগৎজ্যোতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
কয়েকটি সফল অপারেশন সম্পাদনা
জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার সুবাদে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজতর হয়। এর ফলে দাস পার্টির জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জগৎজ্যোতি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে সমর্থ হন। দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ। ১৯৭১-এর ১৬ অক্টোবর পাকবাহিনীর সেই বার্জটিতে আক্রমণ চালিয়ে বার্জটি নিমজ্জিত করে। দাস বাহিনীর গেরিলা অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস শুরু করে। পরবর্তীতে পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করা, বানিয়াচং থানা অপারেশনসহ বেশ ক’টি ছোট বড় অপারেশন দাস পার্টির যোদ্ধারা সফল ভাবে সম্পন্ন করে।
বদলপুর অপারেশন সম্পাদনা
বদলপুর অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি একটি বড় সাফল্য। জগৎজ্যোতির সঙ্গে ছিল বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ আলী মমিন, আমির হোসেন, খালেক মাস্টার, হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া, আজমিরীগঞ্জের রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল, মতিউর রহমান, নিত্যানন্দ দাস, ইলিয়াছ চৌধুরী, আঃ রশীদ, নিপেন্দ্র দাশ, ছাতকের আয়ুব আলী, আঃ মজিদ ও দিরাই উপজেলার আহবাব হোসেন এবং নীলু। জগৎজ্যোতির দল আজিমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। বদলপুরে শত্রুসেনারা দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। গুলি ছোড়ার জন্য হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জগৎজ্যোতির পাশে ছিল ইলিয়াস নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা।
জগৎজ্যোতির মৃত্যু
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহের ছবি দেখেছেন কখনো? দেখে নেন তাহলে। মনে হয় এমন ছবি একটাই আছে। ছবিটা ২২ বছর বয়সী জগৎজ্যোতির। এই ছেলেকে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করতে পেরেছে, সেই প্রাইড ধরে রাখতে শহর থেকে ফটোগ্রাফার এনে ছবি তুলে রেখেছিলো।
আজমিরিগঞ্জ বাজারে সেদিন ছিল হাটবার। বাজার ভর্তি মানুষ। শত শত মানুষের সামনেই বাজারের ঠিক মাঝখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে জগৎজ্যোতির মৃতদেহ বেঁধে লাশকেই মারতে থাকে। এভাবে সারা দিন তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে এবং একসময় ক্ষতবিক্ষত জগৎজ্যোতিকে ভেড়ামোহনার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
একটা জাতীয় পত্রিকা আজ জগৎজ্যোতিকে স্মরণ করে নাই। তার নামে নামকরণ করা হয়নি কোন সেনা প্লাটুনের। ২২ বছর বয়সী ‘দাস পার্টি’র কমান্ডার বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি দাসের মৃত্যুর অর্ধশতবার্ষিকী পূর্ণ হল আজ। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ৭২। বাংলাদেশের গড় আয়ুর হিসেবে তাঁর হাতে বেঁচে থাকার জন্য আরও একটি বছর অবশিষ্ট ছিল এখনো।