এক আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের আত্মকথা
কারোর পৌষ মাস আর কারোর…. বেজায় বাঁশ।আমার কাজ টাই এমন।কারো ক্ষতি করি,কারো উপকার করি।আমার কারণে কারো ঘর আলো ঝলমল হয়,কারো বুকে আমি ই ভয়ের কাঁপন ধরাই।
আমি একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন।ফিলিপস কোম্পানির হাত ধরে আমি বাজারে এসেছি।স্থানীয় হাসপাতালে কদিন দর কষাকষির পর আমার মালিক আমাকে এখানে রেখে গেলেন।গায়ে হাতে বুলিয়ে মনে মনে বলে গেলেন,এখন থেকে এই হাসপাতালের ডাক্তার রাই তোমার মালিক।তুমি তাদের কথা শুনে চলিও।আমার যাবতীয় কর্মপদ্ধতি ধীরেসুস্থে ডাক্তাররা শিখে নিলেন।শিখে নেবার আগে, কত যে ভুলভাল টেপাটেপি চললো কদিন।আমিও মাঝেমধ্যে উনাদের সিগন্যাল দিয়ে সাহায্য করতে লাগলাম।হাজার হোক,মালিককে কষ্ট দেয়া আমার সাজেনা।
এখানে আসার পর থেকে কত লোকের কত উপকার করেছি আমি।আজ শুধুই গর্ভবতী মহিলাদের কথা বলবো।এতো এতো গর্ভবতী মহিলা দেখেছি আমি, গুনে শেষ করা যাবেনা।আমাকে অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাতৃমৃত্যু সংক্রান্ত প্রোজেক্টে অংশ ও নিতে হয়েছিল।সেই প্রোজেক্টের অংশ হিসেবে এই হাসপাতালের অন্যান্য মেশিনের তুলনায় গর্ভবতী নারী আমি বেশি দেখেছি।
আমার বুকে ফুটে ওঠা ২ডি ছবি দেখেও লোকে বাচ্চার চোখ-নাক-মুখ নিয়ে গবেষণা করেছেন।বাচ্চার সুস্থতা, অসুস্থতার ব্যাপারে আগে থেকে জেনে নিয়েছেন।কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চার লৈঙ্গিক পরিচয় জেনে নিয়ে পিংক নাকি ব্লু বেবি শাওয়ার হবে তা ঠিক করতে চেয়েছেন।”ইট’স এ বয়” কিংবা “ইট’স এ গার্ল” লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ফটোসেশন করতে চেয়েছেন।আর কেউবা মুখচুন করে ক্লিনিকে ক্লিনিকে ঘুরে বেড়াবার পরিকল্পনা করেছেন বাচ্চাটাকে পেটের ভেতরেই মেরে ফেলা যায় কিনা, তা জানার জন্য।অনেকের অনেক রকম উপকার করেও আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন হিসেবে অনেককে বেজায় বাঁশ দিয়েছি আমি।বিবাহ বহির্ভূত গোপন সম্পর্কের জেরে পেটে বাচ্চা নিয়ে অনেকে পেট ফুলে যাওয়ার কারণ বের করতে আসেন।আমি যখন দেখাই,পেটে বাচ্চা আছে, তখন তারা আকাশ থেকে পড়েন।তারপর ধাতস্থ হয়ে অতিপ্রাকৃত গল্প জুড়েন,
“আমি বলেছিলাম না,চাচী আম্মা,সেদিন জ্বিন এসেছিল।বাতাস দিয়ে গেছে।”
জ্বিনের বাতাস লাগা সেইসব নারীর কথা শুনলে আজকাল উটপাখি দের কথা মনে হয়,যারা বালিতে মুখ গুজে ভাবে তাদেরকে কেউ দেখেনি।
আবার এমন বাচ্চাও আসে,যাদের মামা,চাচা,বড় ভাই,বন্ধুরা শারীরিক শোষণ করেছে।হ্যাঁ, ধর্ষণ শব্দটা উচ্চারণ করতেও আমার রুচিতে বাঁধে।পাঁচ বছরের যে বাচ্চাটা আমার কাছে এসেছিল,ওর তো নারীসুলভ কোন কিছুই হয়নি।ওর পেট দেখেছিলাম আমি।কিন্তু শুনেছি, ডাক্তাররা বলাবলি করছেন,ওর যোনীপথ নাকি ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করে ফেলা হয়েছে।পরে বালি দিয়ে সেই রক্তপাত বন্ধ করা হয়েছে।জরায়ুতে কোন ইনফেকশন হয়েছে কিনা, সেটা দেখতে গিয়ে প্রথম বারের মতো মানুষ না হবার জন্য দুঃখ হচ্ছিল,কারণ মানুষ নই বলে আমি কাঁদতে পারছিলাম না।আবার শান্তি ও লাগছিল,মানুষ নই বলেই, আমি এরকম জঘন্য কাজ করতে পারিনা।বাচ্চাটার প্রস্রাবের নালী,যোনীপথ আর পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে।আমার দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।প্রস্রাবের থলি ভর্তি ছিল রক্তকণিকায়।বাচ্চারা মাঝেমধ্যেই আসে।শূন্য দৃষ্টি মেলে শুয়ে থাকে।যাদের ঋতুস্রাব শুরু হয়েছে সবেমাত্র, তারা অনেকে নিজের অজান্তেই বাচ্চা ধারণ করে আসে।শারীরিক সম্পর্ক কী,ভালবাসা কী,সেটা বুঝে ওঠার আগেই কঠিন পৃথিবীর কঠিন আত্মীয়রা বাচ্চাগুলোকে তাদের অবসর বিনোদনের মাধ্যম ভেবে নেয়।আমি অক্ষম আক্রোশে তাদের কুকীর্তির ফসল দেখি।একটা নিষ্পাপ প্রাণের ভেতরে আরেকটা নিষ্পাপ প্রাণের বেড়ে ওঠা দেখি।শুধু অপরাধী গুলো কে দেখতে পাইনা।
হয়তো ভবিষ্যতে আমার মধ্যে ছোট্ট কোন পরিবর্তন আসবে,যাতে আমি ছোট্ট এক বিন্দু প্রাণের মধ্যে দেখে নিতে পারবো,তার বাবাকে।এতে হয়তো, অনেক ছোট বাচ্চা তাদের প্রতি হয়ে যাওয়া অন্যায়ের তড়িৎ বিচার পাবে!
আমার সামনে যে ডাক্তাররা বসেন,তারা কখনো বাচ্চার লিঙ্গ কী,তা জানান না আগত গর্ভবতী মহিলা কিংবা তাদের আত্মীয় কে।কিন্তু কত কাহিনী জেনে যাই আমি।তিন বাচ্চার মা এসেছেন,চতুর্থ গর্ভ ধারণ করে।এবারের বাচ্চা যদি ছেলে না হয়,তবে শাশুড়ি ঘর থেকে বের করে দেবে।হাসপাতালেই বউকে ধমকে যাচ্ছে ক্রমাগত।কারো হয়তো,জরায়ুতে টিউমার।আগের একটা ছেলে,একটা মেয়ে আছে।অথচ স্বামী চাচ্ছেন,আরেকটা ছেলে হোক।এবারের সন্তান ছেলে হলে,ভদ্রমহিলা স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেবেন।কিন্তু এবারের সন্তান মেয়ে হলে,আবার এই জরায়ুর টিউমার সহই উনাকে গর্ভধারণ করতে হবে।কেউ এসেছে দশ বছর ধরে ক্রমাগত গর্ভধারণ করে চলেছেন, আর ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে।তবু আশা,এবারে হয়তো টিকে যাবে নাড়ী ছেঁড়া ধন।কেউ এসেছেন,১৫ বছর ধরে একবার ও গর্ভ ধারণ করেন নি।কেন হচ্ছেনা,কোন কারণ ও নেই।কেউ এসেছেন,আগের স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে।ওই সংসারের একটা বাচ্চা আছে।কিন্তু দ্বিতীয় স্বামী চাচ্ছেন, এই সংসারেও একটা বাচ্চা হোক।মহিলার জরায়ু এখন রেস্ট চাচ্ছে।৪৫ বছর পার করে সে আর গর্ভধারণ করতে প্রস্তুত নয়।কত কত কাহিনী….আমি সব জানি।নির্বিকার কাজ করে যাই।
এবারে ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করছি।আপনারা নইলে বিরক্ত হবেন।
চিকিৎসক ম্যাডামের প্রশ্নের জবাবে,ভদ্রমহিলা বলে চলেছেন,
“আমার স্বামী দেশে এসেছেন এক মাস হয়েছে।আগের আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট এ এসেছে আমার বাচ্চার বয়স দুই মাস।ঘরে তুমুল অশান্তি চলছে।তাই, আবার টেস্ট করতে এসেছি”
সালমা বেগম এসেছেন উনার তৃতীয় গর্ভের আল্ট্রাসাউন্ড করার জন্য।আমার দেয়া ছবি আর রিপোর্ট এর উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।এই রোগীরা নিজের শেষ পিরিয়ড এর তারিখ নিজেরা বলতে পারেন না।স্বামী কিংবা পরিবারের অন্য সদস্য দের জিজ্ঞেস করেন, তারিখ যেন কত ছিল?মনে হয় পিরিয়ড উনার নয়, স্বামী কিংবা পরিবারের বাকিদের হয়!
যাই হোক,এবার কিন্তু ঘটনা যথেষ্ট জটিল।সংসার এর ভাঙা গড়া,কয়েকটা প্রাণের বাঁচা মরার বিষয় জড়িত।প্রবাসী স্বামী বলেই দিয়েছেন, এক মাসের বেশি বয়সী বাচ্চা পেটে থাকলে উনি বউকে তালাক দেবেন।সালমা বেগমের আগের দুটো সন্তান!চোখভর্তি অনিশ্চয়তা আছে কিন্তু কোন লজ্জাবোধ নেই!
আল্ট্রাসাউন্ড এ একদম এক্সেক্ট বয়স বলা যায় কি?২-১ সপ্তাহ এদিক সেদিক হতেই পারে।আল্ট্রাসাউন্ড যদি দেড় মাসের গর্ভ দেখায়, হতেই পারে বাচ্চাটা এক মাসের।সেক্ষেত্রে রিপোর্ট পেয়ে যদি বাচ্চার বাবা, বাচ্চার জন্মের আগেই মাকে ত্যাগ করে!
কী নিদারুণ অনিশ্চয়তা, সন্দেহ আর লজ্জা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে শিশুটি!রিপোর্ট নিয়ে আজ সালমা বেগম এর বাসায় কেমন দক্ষযজ্ঞ বাঁধবে,সেটা ভেবেও ভয় লাগছে।স্বামী পরিত্যাক্তা, অনেক গঞ্জনা নিয়ে ঘর ছাড়া সালমা বেগমের অন্য সন্তান দুটো কি মায়ের জন্য লজ্জা পাবে?সালমা বেগম কি প্রবাসী স্বামীর সন্তান কেই ধারণ করছেন?নাকি অন্য কারো সন্তান জঠরে পালন করছেন?তিনি কি ভেতরে ভেতরে লজ্জিত?
পেশেন্ট দের সাথে এই ডাক্তার দিদিমণি প্রচুর গল্প করেন।সালমা বেগম এর গল্প ও জানা হতো না,যদি উনাকে একের পর এক প্রশ্ন না করা হতো!
আমার বুকের উপর ঝলমল করছে,একটা ছোট্ট বিন্দু! বাবা-মায়ের কাছ থেকে ক্রোমোজম নিয়ে এক নতুন মানুষ হবার পথে প্রথম পা রেখেছে সে।আর এখন ই দাঁড়িয়ে আছে, বিরাট এক প্রশ্নের সামনে..কে তার বাবা!
জগতের যত সরলতা,যত পবিত্রতা সব নিয়ে বেড়ে ওঠার কথা ছিল ওর।কিন্তু এখনই সে, সামাজিক কুটিলতায় পতিত হয়েছে।
আঁতকে উঠলাম!
সে তার সামাজিক পরিচয়ে পরিচিত বাবার সন্তান নাও হতে পারে।হতেও পারে!কতদিনের সে?আমি তো মেশিন,আমি কি কখনো পারি কারো অন্তর দেখে নিতে?
ঝলমলে আলোক বিন্দু টাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে!
“বাবা,তুই কার?”
নিজের অক্ষমতায় এবার সত্যি ই বুকে জ্বালা করছে।ওগো মানুষ, তোমরা তো কত কিছুই পারো,আমার বুকে কোন একটা কিছু লাগিয়ে দিয়ে, আমাকেও ক্ষমতা দাও।আমি এই ঝলমলে বিন্দু কিংবা বৃত্ত’র দিকে তাকিয়ে,অদেখা জন্মদাতাকে দেখতে চাই!
©ডাঃ দীপিকা চক্রবর্ত্তী