এতো শান্তি অনেকদিন পাইনি। কড়া উপজাতিদের লাপল।

Uncategorized
কাল দুপুরে হঠাৎ লাপলের ফোন ।
“পিসি, একটা সুসংবাদ দেবার জন্য ফোন করেছি। আমরা যুদ্ধ জয় করেছি। আমি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়েছি।”

এতো শান্তি অনেকদিন পাইনি। শান্তি কথাটাই উচ্চারণ করলাম। কারণ লাপলকে নিয়ে কিছু মানুষের সংগ্রামী পথচলা বেশ কয়েক বছরের। অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টা সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে, লাপলের নিজের কাছে বিষয়টি নবজন্ম কিংবা নতুন সূর্য ওঠা ভোরের মতোই। একটা সাধারণ ঘটনার অসাধারণত্ব এখানেই । কারণ লাপল সেই মানুষ যে তার ‘‘কড়া’’ আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী থেকে এই প্রথম উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়াদের একজন!
কড়া নামে বাংলাদেশে একটা জাতির মাত্র আঠারোটা পরিবার আছে- সে কথা প্রথম শুনেছিলাম রাজীবদা’র মুখে। শুনতে শুনতেই দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামের প্রায় প্রত্যেকেই আমার চেনা হয়ে গিয়েছে। রাজীবদা’র কাছেই শুনেছি রূপম ভাইয়ের নেতৃত্বে তাদের নিবিড় পরিচর্যায় এখন ঝিনাইকুড়িতে কড়া পরিবার আছে ২৪টি। কড়াদের আরও দুটি পরিবার আছে সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার খাড়িপাড়ায়। বিরলের বৈরাগীপাড়ায় চার বছর আগেও একজন ছিলেন। তিনি আর বেঁচে নেই। তার ছেলেমেয়েরাও দেশ ছেড়েছে। এই ২৬টি পরিবার না থাকলে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি জাতি। সংখ্যায় কম, তাই প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই বলে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে জমিগুলো নেওয়ার চেষ্টা করা হয় যখন-তখন। তবে এখন এই ২৬ পরিবারকে উচ্ছেদ করা সহজ নাও হতে পারে। তাদের বুকে জ্বলছে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ় আগুন।
মাত্র ৯৩ জন কড়া আদিবাসী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশে টিকে আছে। নিত্যদিনের ক্ষুধার অন্ন সংস্থান করা এখনো তাদের জন্য কঠিন লড়াইয়ের বিষয়। শুনেছি, লাপোলের মা প্রায়ই বাড়ির পাশের ছোট নালায় ব্রিজের নিচে মাছ ধরতে যান। মাছ না পেলে গুনজুর কুড়িয়ে আনেন। ছোট শামুককে কড়াদের ভাষায় গুনজুর বলে। লাপল কোনো দুপুরে পেট ভরে খেয়েছে শুনলে বুঝে নিতে কষ্ট হয়না পেট হয়তো ভরেছে গুনজুর বা ঝিনুকের শাঁসে।
ঝিনাইকুড়ির গ্রামটি পরিচালিত হয় কৃষ্ণ কড়ার নেতৃত্বে। লাপোল কড়া ইন্টারমিডিয়েট পাস করার আগ পর্যন্ত কড়াদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এই কৃষ্ণ। ভূমিদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করে গ্রামটা রক্ষা করেছেন কৃষ্ণ। স্কুলের গন্ডী পার করা কৃষ্ণের সম্ভব হয়নি কিন্তু তার হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে লাপোলরা।
লাপোল কড়া । বাংলাদেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসা এই আদিবাসী কড়া জনগোষ্ঠীর প্রথম সদস্য, যে এই প্রথম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে যাচ্ছে।
লাপল বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবে। লাপলের হাত ধরে স্বপ্ন দেখবে ৯৩ সদস্যের কড়া জাতিগোষ্ঠী। লাপল কাল খবরটা দিয়ে আমাকেই যেন সম্মানিত করেছে। স্নেহাশীষ লাপল, আমাকে তোমার আত্মীয়ের পরিচয়ে পরিচিতি দেবার জন্য।
লাপলরা যেন বারেবারে জয়ী হয়। তাহলেই জয়ী হবে বাংলাদেশ।
লাপল। আমাদের অস্তরাগের আভা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *