এদেশে মুক্তচিন্তার উপরে আঘাত নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পরপরই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ দিয়ে দেশান্তরী করা হয় কবি দাউদ হায়দারকে।দেশান্তরী হন তসলিমা নাসরিন। আহমদ শরীফকে ঘোষণা করা হয় মুরতাদ হিসেবে। প্রথম আলোর কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমান হন দেশছাড়া। একাধিকবার নিষিদ্ধ হয় হুমায়ুন আজাদের বই। সবশেষে তার উপর চালানো হয় চাপাতি হামলা যা তাঁকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্লগার হত্যা। একে একে হত্যা করা হয় রাজীব হায়দার, মুক্তমনা বাংলা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নীলয় নীল, জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপনকে। হামলা চালানো হয় শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী টুটুল, ব্লগার রণদীপম বসুর উপর। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তারা।
জীবন আশংকায় দেশত্যাগী হয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রথম শ্রেণীর ব্লগার। একদিকে চাপাতি আর একদিকে ৫৭ ধারা নাভিশ্বাস তুলেছে প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, ব্লগারদের মাঝে। অনেকেই তীব্র ক্ষোভে বলে উঠছেন “ধরা যাবেনা, ছোঁয়া যাবেনা বলা যাবেনা কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম কেমন এমন স্বাধীনতা”
ব্রিটিশ ভারতে স্বাধিকারের গান গেয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন কাজী নজরুল। জেল খেটেছেন আরো অনেকে। কিন্তু স্বপ্ন তাদের বৃথা যায়নি।স্বাধীনতার স্বর্ণালী সূর্য ঠিকই উদ্ভাসিত হয়েছিল স্ব মহিমায়।লেখকের কলম আর অনলাইন এক্টিভিস্টদের কী বোর্ড চিরকাল লড়ে চলে অচলায়তনের বিরুদ্ধে। আর তা বন্ধ করে দেয়া তাঁকে হত্যারই নামান্তর। গতবার রোদেলা আবার এইবারে বদ্বীপ বন্ধ করে দিয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চার মূলে আবারো সমূলে কুঠারাঘাত করা হলো নির্দয়ভাবে।
উস্কানি জিনিসটা আসলে আপেক্ষিক। কারণ তার সার্বজনীন মানদণ্ড কখনো থাকতে পারেনা।একজনের কাছে যা উস্কানিমূলক, আরেকজনের তাই চির আরাধ্য। যুগে যুগে অনেক লেখকেরাই কথিত মতে উস্কানি দিয়েছেন।আর সেই উস্কানি ভেঙে ফেলেছে সকল অচলায়তনের বেড়াজাল। বিসর্জন নাটকে কবিগুরু দিয়েছেন উস্কানি, অগ্নিবীণা,বিষের বাঁশিতে নজরুল দিয়েছেন উস্কানি,উস্কানি দিয়েছেন “পথের দাবী”তে শরত , দিয়েছেন প্রবীর ঘোষ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, হুমায়ুন আজাদ,আহমেদ শরীফসহ অনেকেই। তাঁদের দেয়া উস্কানিতে উদিত হয়েছে নতুন সূর্য।হারিয়ে গেছে অন্ধকার। তাহলে কিসের ভিত্তিতে করা যাবে এই তথাকথিত উস্কানির মাননির্ধারণ? অভিজিত রায়ের “বিশ্বাসের ভাইরাস”, বা আলী দস্তির “নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর” যেমন কারো কাছে উস্কানিমূলক মনে হয়, ঠিক তেমনি লজ্জাতুন্নেছা তাবিজের কিতাব, মরণের আগে ও পরে, নুরানি খোয়াবনামা ও হয়তো কারো কারো কাছে উস্কানিমূলক মনে হতে পারে বৈকি। একইভাবে মাও সে তুং এর রেডবুক, বা হফনারের প্লেবয় পত্রিকাও তো উস্কানিমূলক আরব্য রজনী বা বাৎস্যায়নের কামসূত্রের মতো। তাহলে কি হবে সেই উস্কানির ষ্ট্যাণ্ডার্ড?
চাপাতি আর ৫৭ ধারা ইতিমধ্যেই চেপে ধরেছে অনলাইন এক্টিভিস্টদের কণ্ঠ।এখন প্রিন্টিং মিডিয়ার সবচেয়ে বড় উৎসবের প্রাক্কালে মহাপরিচালক মহোদয় দিলেন উস্কানি থিউরি।ঘুরেফিরে মুক্তচিন্তার আর প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠরোধ এর অপচেষ্টা। লেখকের কলমকে আটকে রেখে কোনদিন শৈল্পিক সৃষ্টিকর্ম প্রত্যাশা করা সমীচীন নয়।আস্তিকতা, নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা,বদ্ধ চিন্তা,সাহিত্য,নারীবাদ ,পর্ণসাহিত্য সবকিছু লেখার বা প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। গ্রহণ বা বর্জনের বিচারক পাঠক ব্যতীত আর কেউ তো হতে পারেনা। তারাই নির্ধারণ করবে কোনটি উস্কানিমূলক আর কোনটি মাস্টারপিস। জাতির মনন গড়তে হলে,আলোকিত মানুষ পেতে হলে এই বিধিনিষেধের বেড়াজাল ছিন্ন যে করতেই হবে। তবেই গড়ে উঠবে একটি সত্যিকারের আধুনিক যুক্তিবাদী প্রজন্ম। যুক্তির আকাশে উড়বে মুক্তির বারতা।
কারো লেখা বই বা ব্লগপোস্টে যদি কারো ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয় তবে তার বিরুদ্ধে যে কেউ আইনের আশ্রয় নিতেই পারে।কিন্তু কারো কোন লিখিত অভিযোগ ছাড়াই বই নিষিদ্ধ করণ ,স্টল বন্ধ করে দেয়া, সর্বোপরি লেখককে গ্রেফতার করা ঘুরেফিরে পরাধীনতার দিনগুলোকেই কি স্মরণ করিয়ে দেয়না?
এক হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু শত হুমায়ুন আজাদের পথ দেখিয়েছে, এক মৃত অভিজিৎ জন্ম দিয়েছেন হাজারো জীবিত অভিজিতের।সংস্কৃতি হল নদীর মতো। যার স্বভাবই বহতা।কোন রকম বাধ দিয়ে সেই বহমান স্রোতকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি কোনকালে,যাবেওনা।হেমলক পারেনি সক্রেটিসের শিক্ষা মুছে দিতে, নির্মমতা পারেনি ভুলিয়ে দিতে হাইপেশিয়াকে। গ্যালিলিওর পৃথিবী আজো চার্চের নির্দেশ অমান্য করে সূর্যকে ঠিকই প্রদক্ষিণ করে চলেছে। অন্ধকারের শৃঙ্খল ভেঙে নতুন সূর্যের আলোকচ্ছটা এভাবেই যুগ যুগান্তর ধরে আলোকিত করে চলেছে এই মহাবিশ্বকে।
স্যার , সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে দ্রুত। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে হলে আপনার মতো সাহসী কাণ্ডারীদের যে হাল ধরতেই হবে।
রাজেশ পাল