কালো মেয়ের কথা

Uncategorized
#কালো_মেয়ের_কথা
ছোটবেলায় অনুষ্ঠান বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এসে আমার সাথে তুলনায় দিদির রূপের প্রশংসা করত ভারি। তারপর মা কে বলত, “গায়ের রং কালো তো কি হয়েছে। দেখবে একটা চাকরি পেলে ওর ও ভালো বিয়ে হবে।”
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের বিয়ের বাজারে চাকরি পাওয়া বাধ্যতামূলক।
আমার টুকটুকে লাল ছিলো বড্ড প্রিয়। কিন্তু একটু বড়ো হতে দেখলাম পুজোতে আমার জন্য হালকা রঙের পোশাক পাঠাত পরিচিত’রা। মা বলতো, “এই দেখ এই হালকা গোলাপী তে তোকে সুন্দর লাগবে দেখিস।”
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের টুকেটুকে লাল রঙের পোশাক পরতে নেই। 
উঁচু ক্লাসে উঠতে আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে একসাথে স্কুলে যেতাম। প্রচন্ড রোদে পুড়ে পুড়ে বাড়ি ফেরার সময় আমার বান্ধবী রা গল্প করত কিভাবে ট্যান রিমুভ করা যায়। আমি আগ্ৰহ সহকারে শুনতে গেলে বলত, “তুই তো কালো। তোর ট্যান রিমুভের প্রয়োজন পরবে না। ” 
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের ত্বক রোদে জলে বৃষ্টিতে কখনো খারাপ হয় না। 
কলেজে ঢুকে ভাবলাম সবাই বুঝি রঙ দেখে! এখনো কেউ কেউ নিশ্চয়ই মন দেখে। আর সত্যিই একজন আমার ‘কালো হরিণ চোখ’ দেখে প্রেমে পড়েছিলো। প্রেমের শুরুতে সে বলেছিলো আমার গায়ের রং নয়, আমি মানুষ টাকে সে ভালোবাসে। তারপর কলেজ পাশের পর সে হঠাৎ করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি বহু কষ্টে ওর বাড়ির নাম্বার জোগাড় করে ফোন করতে বলল, “আমাকে নিয়ে সারাজীবন চলা যায় না, কোনো ভদ্র অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে গেলে ওর লজ্জা করবে।” 
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের ভদ্র সমাজে জায়গা নেই। 
তারপর অনেক বছর বাদে একজন কবির সাথে আলাপ হয়েছিলো আমার। সে আমাকে বলেছিলো কালো মেয়ের প্রেমেই সে পাগল হয়েছে। নিজেকে বড্ড দামি মনে হয়েছিলো তখন। সে আমার শরীরের সমস্ত আঘ্রাণ নিয়ে লিখে ফেলত একের পর এক কবিতা। তারপর একদিন আমাকে নিয়ে লেখা কবিতা থেমে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করতে জবাব পেলাম, “কবিদের মন চিরস্থায়ী নয়।” 
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের নিয়ে কাব্য করা চলে, চিরস্থায়ী প্রেম নয়। 
চোখে থাকা জলের দাগ মুছে বসে পড়তে থাকলাম পাত্রপক্ষের সামনে। মা মাখিয়ে দিত চড়া দামের লিপস্টিক, পাউডার। তবুও একের পর এক, একের পর এক পাত্রপক্ষ আমাকে বাতিলের খাতায় তুলে দিয়ে চলে যেতে থাকল। এর মাঝে বাবার প্রেশার ফল করল একদিন, মা বললো, “সর্বনেশে মেয়ে এত সহজে বিদায় ও হবে না।” 
আমি বুঝেছিলাম কালো মেয়েদের সংসার থেকে বিদায় হওয়া জরুরি। 
এখন আমি একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করি। মাস শেষে নিজের টাকায় ঘর ভাড়া দি। সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে নিজের মন মতো রান্না করি। রাত নামলে চাঁদের আলোয় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আমি এখন বুঝেছি কালো মেয়েদের নিজের মতো বাঁচার অধিকার অর্জন করে নিতে হয়। কেউ তাকে এগিয়ে এসে আত্মসম্মান উপহার দিয়ে যায় না। কালো মেয়েদের নিজের মতো বাঁচা শিখে যেতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *