তাঁর পড়াশোনা শেষ হয়ে গিয়েছিলো প্রায় অজপাড়াগাঁ শেওড়াতলী গ্রামের টোলে পড়া অবস্থাতেই।
.
বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন স্থানীয় বলিয়াদী বাজারের দরিদ্র মুদি দোকানী৷ মেঘনাদ পড়তেন গ্রামের টোলে। টোলে পড়া শেষে এসে বসতেন বাবার দোকানে। একসময় বাবাই তাঁকে টোল থেকে ছাড়াতে গিয়ে বলেছিলেন ‘পড়ে কি আর মোক্তার ডাক্তার হইবো!’
.
বাবার নির্দেশে সেই টোলের পড়া ছেড়ে একসময় বাবার মুদি দোকানেই পাকাপাকি বসেছিলেন মেঘনাদ সাহা। কিন্তু তারপরেও নিজে নিজেই দোকানে পড়তেন তিনি। মেঘনাদের পড়াশোনায় প্রচন্ড আগ্রহ দেখে বড়দা জয়নাথ ও মা ভুবনেশ্বরী দেবী এগিয়ে এসে বাবাকে বোঝালেন। কিন্তু দরিদ্র বাবার পক্ষে দশ সদস্যের সংসারের খরচের পর পড়াশোনার খরচ সামলানো সম্ভব না।
.
তবুও তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিলো বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরের এক প্রাইমারী স্কুলে। বাড়ি থেকে রোজ পায়ে হেঁটে পড়তে যেতেন স্কুলে। সেখানেও বিপত্তি। টানাটানির সংসারে একসময় স্কুলের কাছাকাছি ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন কিশোর মেঘনাদ। বিনিময়ে বাড়ির গোয়ালঘর দেখাশোনা, বাসন মাজার মতো কাজ করতে হতে মেঘনাদকে। তাতেই জুটতো খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই।
.
কিন্তু অনন্ত দাসের বাড়িতে ছিল জাতপাত নিয়ে চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। মেঘনাদ নিম্নবর্ণের ছেলে। বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ ছিলো তাঁর।
.
সমগ্র পূর্ববঙ্গে এন্ট্রান্স তথা আজকের দিনের মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন প্রথম।
.
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর সহপাঠীদের নাম শুনলে অবাক হতে হয়! একাধারে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রনাথ গুহ, সুরেন্দ্র নাথ মুখার্জীর মতো কিংবদন্তীরা তাঁর সহপাঠী। অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই মেঘনাদ সাহা হয়েছিলেন দ্বিতীয়। আবার দুটোতে প্রথম হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
.
অথচ এই মেঘনাদ সাহাই যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে উঠেছিলেন তাঁকে দেখে নাক সিটকে ছিলো উচ্চ বর্ণের হিন্দু ছাত্ররা। কারন তিনি কথিত নিম্ন বর্ণের। একবার সরস্বতী পুজোর দিন পূজার মণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। তারা বলেছিলল ‘তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না।’
.
কেবল এগিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দুই সহপাঠীর মধ্যে গড়ে উঠলো গভীর বন্ধুত্ব। একদিন মেঘনাদ সাহা দেখলেন বিশ্বখ্যাত সব বিজ্ঞান বিষয়ক আর্টিকেলই প্রকাশিত হয় জার্মান ভাষায়। তিনি জার্মান জানতেন না। সবকিছু খুলে বললেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।
.
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিখেছিলেন জার্মান।
.
বিখ্যাত প্রিন্সিপালস অব রিলেটিভিটি তথা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আবিষ্কারের তিন বছর পর তিনি ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু সেটি জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই দুজনের আগে কেউ তখন পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় প্রিন্সিপালস অব রিলেটিভিটি অনুবাদ করেনি। তাঁরাই ছিলেন প্রথম অনুবাদক।
এই দুই কিংবদন্তি সহপাঠীর মধ্যে যে কতোটা বন্ধুত্ব ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাঁদের শিক্ষকতাও শুরু হয়েছিলো একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে।
.
সকালে পান্তা খেয়ে বাবার মুদি দোকানে বসা সেই মেঘনাদ সাহার জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ ‘On the physical theory of steller sprectra’ প্রকাশিত হয়েছিলো রয়েল সোসাইটি পাবলিশিং থেকে। বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এস রজল্যান্ড তাঁর Theoretical Astrophysics গ্রন্থে মেঘনাদ সাহার গবেষণা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন স্বকৃতজ্ঞ চিত্তে।
.
এই মেঘনাদ সাহাই একসময়ে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের জাতি বিদ্বেষে অতিষ্ঠ হয়ে নিজের বাবার নাম বদলে ফেলেছিলেন। ঘটনাটা জানা যায় ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারিতে এসে। স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা লিখেছিলেন , ‘যে দিন আমার বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দুদের পুরাণ অনুযায়ী ঝড় ও জলের দেবতা হলেন দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে বাবার নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামিতে বাবাকে এতোটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। তথা দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি।’
.
সেই মেঘনাদই জ্ঞানের প্রদীপ আর উৎকর্ষতাকে নিজের মধ্যে বিদ্যমান রাখেননি। তাঁর আরেকটি প্রমাণ মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মেঘনাদ সাহার হাতে গড়া পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চ’।
.
গোটা ভারতে যে আজ ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি গুলোর জয়জয়কার। ২৩টি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে তাঁরই স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মেঘনাদ সাহা।
.
পাঁচ পাঁচ বার নোবেল কমিটিতে তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়েছিলো। তিনি যদি নোবেলও পেতেন নোবেল দিয়েও কি তাঁকে পরিমাপ করা যেত!?
সহপাঠী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর (বিজ্ঞানী এসএন বোস, সাবেক শিক্ষক, ঢাবি, যার নামে বোসন কণার নামকরণ হয়। আইনস্টাইনের সমীকরণের ভূল ধরেন যিনি।) থেকে তিন মাসের অগ্রজ ছিলেন মেঘনাদ সাহা। কিন্তু বন্ধু ও সহপাঠীর মতো যদি ১৮ বছর আয়ু বেশী পেতেন তবে বিজ্ঞানে বাংলা কতোদূর এগিয়ে যেত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
গতকাল ছিলো কিংবদন্তি মেঘনাদ সাহার জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীকে।🙏💕
collected