খুঁজে ফিরি!
অনেকেই ভাবে, আমি আওয়ামীলীগ করি। সেই অনেককে বলি, আমি আজ পর্যন্ত কোনো দলের হয়ে রাজনীতি করিনি, কোনো মিছিলে যাইনি, শ্লোগান দেইনি।
আমি নারায়ণগঞ্জের মেয়ে। নারায়ণগঞ্জ -এর জনগণ ব্রিটিশ আমল থেকেই রাজনীতি সচেতন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের কত বিপ্লবী ছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলনের উপর লেখা বইয়ের কত কত পাতায় লেখা আছে নারায়ণগঞ্জের কথা, নারায়ণগঞ্জের বিপ্লবীদের কথা।
এরপর এলো পাকিস্তান পর্ব। এই অধ্যায়েও পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতিটি আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের জনগণ সরাসরি যুক্ত ছিলো।
আওয়ামীলীগের জন্ম ইতিহাসে নারায়ণগঞ্জের নাম সর্ব প্রথম উচ্চারিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ‘৬৯-র গণ আন্দোলনের সময়, ‘৭০-এর নির্বাচনের সময় আমাদের বাসার সামনের পিচ ঢালা রাস্তায় কত মিছিল যেতো, মশাল মিছিল যেতো।
বয়সে শিশু ছিলাম, তারপরেও সেই সব দিনের ছবিগুলো স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।
সেই নারায়ণগঞ্জের কন্যা আমি, রাজনৈতিক সচেতনতা তো মস্তিষ্কের কোষে কোষে জমা আছে। রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা আর রাজনীতির মাঠে থাকা এক কথা নয়।
ছোটোবেলায় নারায়ণগঞ্জে চারপাশে আওয়ামীলীগ আর কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নেত্রী কর্মীদেরকে রাজনীতি করতে দেখেছি। নারায়ণগঞ্জের বাতাসে তখন বিএনপি জাতীয় পার্টি জামাত হেফাজতের গন্ধ ছিলো না।
যাদের আওয়ামীলীগ, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করতে দেখেছি, তাঁরা ছিলেন আমাদের কাছে অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। দুটি আলাদা দল হলেও দুই দলের রাজনীতি এবং কর্মী সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ ঝগড়া মারামারি দেখিনি।
এই দুটি দলের নেতা নেত্রীদের দেখলে মনে শ্রদ্ধা জাগতো।
এই দুই রাজনৈতিক দলের সদস্যদের জনকল্যাণকর কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখে মনে হতো, রাজনীতি করা অত্যন্ত সম্মানের কাজ। সম্মানের কাজ অনেক কঠিন হয়ে থাকে, জীবনে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।
এমন দুটি দলের রাজনীতি দেখে বড়ো হয়েছি বলেই এই মাঝ বয়সে এসেও এই দুটি দলের প্রতি এখনও দুর্বলতা অনুভব করি।
কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনীতি নোংরামি আর লোভ লালসার ক্ষেত্র হয়ে গেছে। মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই একেকজন ‘নেতা’ ‘ নেত্রী’ হয়ে যাচ্ছে!
এতো নেতা নেত্রীর ভীড়ে আমি আমার সেই ছোটবেলায় দেখা আওয়ামীলীগকে খুঁজে পাই না, কমিউনিস্ট পার্টির সর্ব ত্যাগী কাউকে খুঁজে পাই না।
যারা আছে তাদের কাউকে চিনতে পারি না।
অন্যান্য বর্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে সেই শৈশবের ভালো লাগা আওয়ামীলীগ উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলেছে, আর কমিউনিস্ট পার্টি দলটাই হারিয়ে গেছে।
** আগে রাজনীতি বুঝলেও রাজনীতি করার নেশা ছিলো না। কারণ রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের জীবন খুব বেশী সহজ সুখের ছিলো না!
এখন তো রাজনীতিই বুঝি না রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের রাজনীতি খুব বেশী জটিল আর দুর্নীতি-যুক্ত হয়ে উঠেছে বলে।**
** তারপরেও রাজনীতি থাকবে, রাজনীতির ভালো মন্দ দিকও থাকবে। রাজনীতির মাঠে নির্বাচন থাকবে, নির্বাচনে ভোটাভুটি থাকবে, জনগণ থাকবে, নেতা নেত্রী থাকবে, সব থাকবে, থাকবে না শুধু শৈশবে দেখা রাজনীতির আমেজ।
ফেসবুকে নানারকমের নির্বাচনী সংবাদ পড়ি, আনন্দ পাই না কোনো সংবাদ পড়ে।
মনটায় চায়, ইতিবাচক সংবাদ পড়তে, সেই শৈশবের মতো।
রিকশা দিয়ে মাইক বাজিয়ে সাড়া পাড়া টহল দিতে দিতে গাইবে কেউ, ” যোগ্য ব্যক্তি দাঁড়িয়েছে মাহবুব ভাই, চেয়ার মার্কায় ভোটটা যেন সবার কাছে পাই”।
অথবা চুনকা ভাইয়ের মার্কা, দাঁড়িপাল্লা দাঁড়িপাল্লা! জালাল হাজীর মার্কা, সাইকেল সাইকেল!
অথবা, মার্কাডা কি, লাঙ্গল!
কোথাও কোনো মারপিট নেই, নিপুন মণি চুনি পান্না হীরা নামের মারদাঙ্গা নেত্রী নেই।
নির্বাচনের সকালে মা দিদিমা মাসীমারা সেজেগুজে তৈরী, আদর্শ স্কুলে ভোট সেন্টার।
দল বেঁধে ভোট দিতে যাওয়া, আমরা ছোটরা তাদের পিছে পিছে টেন্ডলের মত ছুটতাম। চারদিকে উৎসব! বিকেল হতেই ভোট গণনার ফলাফল আসতো!
এটা শুনতেও কি আগ্রহ, কত উত্তেজনা! সবই আনন্দের, কোথাও কোনো প্রাণহানি, মানহানির খবর থাকতো না!!
আমরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করিনি, গাড়ি চড়িনি, এয়ারকন্ডিশনড ফ্ল্যাটে থাকিনি।
খেলা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে বন্ধুদের সাথে তর্ক করেছি ঝগড়া করেছি, তবে খুনোখুনি করিনি।
বন্ধুদের সাথে খেলা করেছি, আড়ি করেছি, আবার ভাবও করেছি।
আমাদের ছোটো থেকে বড়ো হওয়া ছিলো ভীষণ সহজ সরল আনন্দময়।
এমন দিন কি আর আসবে ফিরে, কালের ভেলায় চড়ে! ( আর্কাইভ থেকে)