হোমো সেপিয়েন্স আরো বিব্রতকর একটা সত্য এতদিন গোপন করে এসেছে। সেপিয়েন্সের যে কেবল অনেকগুলো অসভ্য, বন্য জ্ঞাতিভাই আছে তা-ই নয়, ইতিহাসের একটা পর্যায়ে আমাদের বেশ কিছু আপন ভাইবোনও ছিল। আমরা এতদিন নিজেদেরই একমাত্র মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি, কারণ গত ১০ হাজার বছর ধরে শুধু এই সেপিয়েন্সরাই পৃথিবীতে মানুষ গোত্রের প্রাণী হিসেবে টিকে আছে। আমরা ইতিমধ্যে যে জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি দেখেছি সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ‘মানুষ’ শব্দটার সত্যিকার মানে হলো ‘হোমো (ঐড়সড়) গণের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী’। অতীতে এই ‘হোমো’ নামক গণটির আরো অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। এই বইয়ের শেষের অধ্যায়ে আমরা দেখব, অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো আমাদের এই হোমো গণের অন্য প্রজাতির মানুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এই নামকরণের ব্যাপারটা পরিস্কার করার জন্য, আমরা অধিকাংশ সময়ই ‘সেপিয়েন্স’ বলতে শুধু হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটিকে বোঝাব, আর ‘মানুষ’ শব্দটা হোমো গণের সব প্রজাতির মানুষের জন্য সংরক্ষিত রাখব।
মানুষের প্রথম সন্ধান মেলে পূর্ব আফ্রিকায়, প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে। তারা কিন্তু শূন্য থেকে আসেনি, প্রথম দিককার নরবানরের একটি শ্রেণি অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) থেকে বিবর্তনের মাধ্যমেই তাদের উদ্ভব। এ জটিল আকারের নামের সঙ্গে কিন্তু ভূগোলের অস্ট্রেলিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অস্ট্রালোপিথেকাস-এর শাব্দিক অর্থ হলো দক্ষিণের নরবানর (Southern Ape)। প্রায় ২০ লাখ বছর আগে কিছু মানুষ পূর্ব আফ্রিকা ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি নতুন জায়গায় এরা বিরূপ অবস্থা, নতুন ধরনের আবহাওয়া ও জলবায়ু, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থা, নতুন নতুন প্রাণী, অচেনা গাছপালা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়। এতসব অচেনা অবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন-ভিন্নভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। অনেক অনেক বছর ধরে এরকম চলার পর মানুষের অনেকগুলো আলাদা আলাদা প্রজাতি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করে এবং পরবর্তী সময়ে ক্সবজ্ঞানিকেরা নিজেদের মতো করে সবগুলো প্রজাতির আলাদা আলাদা ল্যাটিন নামকরণ করেন।

কাল্পনিক পুনর্গঠন অনুসারে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সহোদরেরা (বাঁ থেকে ডানে): হোমো রুডলফেনসিস (পূর্ব আফ্রিকা), হোমো ইরেক্টাস (পূর্ব এশিয়া) ও হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া)। এরা সবাই মানুষ।
পশ্চিম ইউরেশিয়ায় (ইউরোপ ও এশিয়া) মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস (Homo Neanderthalensis) বা সংক্ষেপে নিয়ান্ডার্থাল (Neanderthals)। এর সহজ মানে হলো- নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ। নিয়ান্ডার্থালরা আমাদের থেকে আকারে অনেক বড়োসড়ো এবং পেশিবহুল ছিল। এরা বরফযুগে পশ্চিম ইউরেশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পেরেছিল। এশিয়ার একদম পূর্বের দিকে মানুষের যে প্রজাতি বিকাশ লাভ করে তাদের নাম হোমো ইরেকটাস (Homo Erectus) বা ‘খাড়া মানুষ’। এরা প্রায় ২০ লাখ বছর পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে পেরেছে। মানুষের আর কোনো প্রজাতি পৃথিবীতে এত বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। আজকের আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সও এই ২০ লাখ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পক্ষে আরো ১ হাজার বছর পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব হবে কি না সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়, লাখ লাখ বছর তো অনেক দূরের ব্যাপার!
এবারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মানুষের আরেকটি প্রজাতি বিকাশ লাভ করে, যাদেরকে বলা হয় হোমো সলোয়েনসিস (Homo Soloensis) বা সলো উপত্যকার মানুষ। এদিকে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস নামের ছোট্ট একটি দ্বীপে তখন লেখা হচ্ছে ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিকাশ হচ্ছে ছোটো আকারের এক প্রজাতির মানুষের, সেপিয়েন্স প্রজাতির বিজ্ঞানীরা অনেক পরে যার নাম দেবেন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (Homo Soloensis) বা ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ। মানুষ যখন প্রথম ফ্লোরেস দ্বীপে পৌঁছায় তখন সমুদ্রের পানির উচ্চতা ছিল একেবারেই কম। ফলে মানুষ সহজেই ফ্লোরেস থেকে মূল যাতায়াত করতে পারত। সময় যতই অতিবাহিত হলো সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকল। একসময় ফ্লোরেস দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এর ফলে কিছুলোক ফ্লোরেস দ্বীপেই আটকা পড়ে গেল। ফ্লোরেস ছিল খুবই ছোটো একটি দ্বীপ। এরকম ছোটো একটি দ্বীপে অনেক লোকের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবারের সরবরাহ থাকে না। ফলে লম্বা ও মোটা-তাজা লোকজন, বেশি বেশি খাবার ছাড়া যাদের চলে না, প্রথমেই তারা খাবারের অভাবে মারা পড়ল। কিন্তু ছোটোখাটো লোকজন ও প্রাণী, যাদের বেঁচে থাকার জন্য কম খাবারের প্রয়োজন হয় তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকল।
অনেক অনেক বছর ধরে এই ঘটনা ঘটে চলল। ছোটো আকারের মানুষদের কম খাবার খেয়েও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল। এ কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছোটো আকারের মানুষরাই বেশি সংখ্যায় টিকে থাকল। এভাবে ফ্লোরেস দ্বীপের মানুষ একসময় বামনে (ছোটো আকারের মানুষ) পরিণত হলো। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সর্বোচ্চ এক মিটার (৩ ফুট) উচ্চতার এবং ২৫ কিলোগ্রাম ওজনের হতো। কিন্তু আকারে ছোটো হলেও তারা মানুষের অন্যান্য প্রজাতির মতোই বর্শাসহ পাথরের নানা রকম হাতিয়ার তৈরি করতে পারত এবং এসব হাতিয়ার দিয়ে তারা মাঝে মাঝে হাতিও শিকার করত! যদিও, সত্যি কথা বলতে কি, সেই হাতি অন্যান্য এলাকার হাতির মতো দশাসই আকারের হাতি ছিল না, ছিল বামন হাতি! এই হলো বামনরাজ্য ফ্লোরেস-এর গল্প।
২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহায় খননকাজ চালাতে গিয়ে মানুষের একটি আঙুলের ফসিলের সন্ধান পান, যা কিছুদিন পর আমাদের সামনে নিয়ে আসে মানুষের হারিয়ে যাওয়া আরেকটি প্রজাতিকে। জিনগত গবেষণা থেকে বোঝা যায়, এই ফসিলটি থেকে প্রাপ্ত জিন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মানুষের সবগুলো প্রজাতির থেকে আলাদা। বিজ্ঞানীরা মানুষের নতুন এই প্রজাতির নাম দিয়েছেন হোমো ডেনিসোভা (Homo Denisova) বা ডেনিসোভা গুহার মানুষ। কে জানে কোন দেশে, কোন অচেনা গুহায়, কোন নির্জন দ্বীপে মানুষের নাম-না-জানা কত প্রজাতির নিদর্শন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আবিষ্কৃত হওয়ার প্রত্যাশায়।
যখন ইউরোপ ও এশিয়ায় বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের এসব নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে, তখন পূর্ব আফ্রিকাতেও কিন্তু বিবর্তন থেমে থাকেনি। সেখানেও মানবজাতির আঁতুড়ঘরে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন প্রজাতি। তৈরি হয়েছে হোমো রুডলফেনসিস (Homo Rudolfensis) বা রুডলফ হ্রদের মানুষ, হোমো ইরগেস্টার (Homo Ergaster) বা কর্মঠ মানুষ এবং সবশেষে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রজাতি, নিজেদের যারা হোমো সেপিয়েন্স বা জ্ঞানী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতিগুলোর মধ্যে কিছু ছিল বিশাল আকারের, কেউ ছিল বামন। কেউ কেউ ছিল তুখোড় শিকারি আবার কেউ শুধু ফলমূল খেয়েই বেঁচে থাকত। কোনো প্রজাতি একটি দ্বীপের মধ্যেই সারাটা জীবন কাটিয়েছে, কেউ আবার ভ্রমণ করেছে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ। কিন্তু তারা সকলেই ছিল এক মানবজাতির অংশ। তারা সবাই ছিল মানুষ। মানুষের এই বিভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হলো, মানুষের একাধিক প্রজাতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কখনোই একসঙ্গে বসবাস করেনি, বরং প্রজাতিগুলোর একটি থেকে অন্যটির জন্ম হয়েছে। যেমন, ইরেকটাস-এর জন্ম হয়েছে ইরগেস্টার থেকে, নিয়ান্ডার্থালের জন্ম হয়েছে ইরেকটাস থেকে এবং নিয়ান্ডার্থাল থেকে আমরা এসেছি। মানুষের একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির তৈরি হওয়ার এই ধারণা আমাদের এটা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে যে, মানুষের একের অধিক প্রজাতি কখনো একসঙ্গে পৃথিবীর বুকে বসবাস করেনি, একটি নতুন প্রজাতি মানুষের পূর্ববর্তী আরেকটি প্রজাতির উন্নত সংস্করণ মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০ লাখ বছর আগে থেকে শুরু করে ১০ হাজার বছর আগেও পৃথিবী ছিল মানুষের অনেকগুলো প্রজাতির বাসভূমি। কেন নয়? আজকের পৃথিবীতে একই সময়ে অনেক প্রজাতির শেয়াল, ভালুক আর শূকর বসবাস করছে। একইভাবে ১ লাখ বছর আগের পৃথিবীতে একই সঙ্গে মানুষরে অন্তত ছয়টি প্রজাতি হেঁটে বেড়িয়েছে, বসবাস করেছে পৃথিবীর বুকে। প্রাণিজগতে অন্যদের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, একসঙ্গে একাধিক প্রজাতির সহবস্থানের ব্যাপারটাই স্বাভাবিক, বরং আজকের আধুনিক বিশ্বে যে মানুষের কেবল একটি প্রজাতি বসবাস করছে সেই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক, খাপছাড়া। একটুপরেই আমরা দেখব, আধুনিক মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থেই মানুষের অন্যান্য প্রজাতির ইতিহাস ধামাচামা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।