রাজধানী ঢাকায় সকাল থেকেই থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আর এদিকে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের চুনিয়া গ্রামে জ্বলছিল চিতার আগুন। দুটি ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এক হয়ে যায় যখন চিতায় শুয়ে থাকেন গারো বা মান্দিদের আদি সাংসারেক ধর্মের খামাল (পুরোহিত) জনিক নকরেক। গতকাল মেঘাচ্ছন্ন মধুপুরে ভালোবাসার মানুষদের চোখের বৃষ্টিতে বিদায় নিলেন এই জ্ঞানবৃক্ষ। প্রায় ১২০ বছর বয়সী জনিক ছিলেন সাংসারেক ধর্মের প্রায় সব আচার ও ২৩৪টি পূজা জানা দুর্লভ মানুষদের একজন। গত শুক্রবার সকালে তিনি মারা যান। যার সঙ্গে শেষ হয়ে যায় প্রাচীন এক অধ্যায়ের, যে অধ্যায়ের খোঁজে আদিবাসী-বাঙালি লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা বারবার ছুটে যেতেন মধুপুরে, যাকে তারা ‘আচ্চু’ (দাদা বা নানা) নামে ডাকতেন।
গতকাল শনিবার সকাল থেকেই চুনিয়া গ্রাম ভরে উঠেছিল বিষাদে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সেখানে আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন জনিকের শিষ্য, জ্ঞানমুগ্ধ আর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সবাই নিচ্ছিলেন এমন এক যাত্রার প্রস্তুতি, যে যাত্রাটিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন জনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রাণে। সে প্রাণ মানে শুধুমাত্র মানুষ নয়। প্রকৃতির ভারসাম্যে অবদান রাখা গাছ, পোকামাকড়, বৃষ্টিসহ সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। গাছের অবদান আমাদের জন্য যেমন আছে, আমাদেরও অবদান গাছের জন্য। এই পৃথিবীর, প্রকৃতির কোনোকিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, সবকিছু মিলেই তৈরি হয় প্রাণ।
জনিক নকরেক ও সাংসারেক ধর্মের এমন চিন্তা থেকেই এই ধর্মের অনুসারীদের শেষকৃত্যে ব্যবহার করা হয় ‘প্রাকফাঙ’। মান্দিদের আচিক ভাষার শব্দটির বাংলা অর্থ বটগাছ। রীতি অনুযায়ী, প্রাকফাঙকে পূজা করা হয়, তাই নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দিতেই শেষকৃত্যে প্রাকফাঙের ব্যবহার। প্রায় সাড়ে সাত ফুট উঁচু চিতায় যখন ওঠানো হয় জনিককে, তখন চারদিকে কান্নার রোল। প্রবাদপ্রতিম মানুষটি তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকৃতির মাঝেই মিশে গেলেন।
এর আগে জনিক নকরেককে রাখা হয়েছিল ‘নকমান্দি’ ঘরে। সাংসারেকদের আচার অনুযায়ী বানানো এক বিশেষ রকমের ঘর নকমান্দি।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিলের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো জনিক নকরেকের। চুনিয়াতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। তিনি জনিক সম্পর্কে সমকালকে বলেন, জনিক আচ্চুর নিজস্বতা ও মানসিক পরিপক্কতা আমাকে আকর্ষণ করত। যে দীর্ঘ সময়টা তিনি বেঁচে থেকেছেন, সেই সময়টাকে আমি অর্জন বলে মনে করি। আচ্চু নিজের প্রাণকে ধরে রেখেছেন, সবসময় সক্রিয়ভাবে বেঁচে থেকেছেন। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে প্রকৃতির সঙ্গে নিজের যোগসূত্র তিনি স্থাপন করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এর অনেক উদাহরণ আমি পেয়েছি। তিনি অনেক জ্ঞানী ছিলেন, তবে সেটি ছিল প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান। জ্ঞানের চর্চা এভাবেই হওয়া উচিত।
জনিক নিজের জাতিসত্ত্বার মৌলিকতা খুঁজে বের করতে জীবন ব্যয় করেছেন উল্লেখ করে এ শিক্ষক ও গবেষক বলেন, সাংসারেক ধর্ম নিজেদের প্রচারে বিশ্বাসী নয়, তাদের দর্শন নিজেদের মধ্যে চর্চায়। তার জীবন যাপনটাই হচ্ছে তার দর্শনকে প্রতিফলিত করার লড়াই। এই লড়াইয়ে আগ্রাসনের রূঢ়তা নেই। তিনি কারও কাছে যাননি, সবাই তার কাছে জানার আগ্রহ নিয়েই আসতেন। মানুষ চিনতে পারারও নানা ধর্মের ও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মতো বিরল ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি। ছিলেন বাস্তববাদী ও যৌক্তিক মানুষ।
প্রাণ ও প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, জনিক নকরেক নিজে আমাদের কাছে মানবসমাজের একজন বিশাল বটবৃক্ষ, একজন দার্শনিক, যার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আমরা জ্ঞান আহরণ করেছি। এই যে গাছ হিসেবে প্রাকফাঙ আর মানুষ হিসেবে প্রাকফাঙ একসঙ্গে মিলে যাচ্ছে, এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এর থেকে আমরা সারা পৃথিবীতে গাছের সঙ্গে মানুষের, মেঘের সঙ্গে মাটির সম্পর্কের বিষয়টি বুঝতে পারি। এই দার্শনিক প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মেলানোর এবং জীবনের সঙ্গে জীবন মেলানোর প্রচেষ্টাই করে গেছেন আজীবন, আমরা সেটাই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
বিভিন্ন সময়ে জনিক নকরেক তার কাছের মানুষদের বলেছিলেন ছোটবেলায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা শোনার কথা। পরে যৌবনে দেখেছেন ব্রিটিশ শাসন। ভারত ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এই অঞ্চলের পটপরিবর্তনকারী ঘটনাগুলোর সাক্ষী ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা বাংলোতে অবস্থানের সময় দেখা করার ঘটনাটি তার জীবনের অন্যতম বড় স্মৃতি। এ সময় চুনিয়া গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর পা পড়েছিল জনিকের কুটিরে।
শেষকৃত্য শেষে ঘরে ফেরার সময় মান্দি মেয়েরা কান্না করে পানি ছিটাচ্ছিল হাঁটার পথে। আর জনিকের উদ্দেশে বলছিল, ‘তুমি পরের জনমে আবার মান্দি হয়েই এসো। এই ঘরে, তুমি আমাদের ঘরেই ফিরে এসো আবার।’ জনিক ফিরবেন কিনা, কেউ জানে না। তবে সবার প্রত্যাশা, তিনি প্রাণকে ভালোবাসার যে বীজ বুনে দিয়ে গেছেন সবার মনে, সেটি একদিন ‘প্রাকফাঙ’ হয়ে উঠবে।
শেষ সাংসারেকের শেষকৃত্যের খবরটি লিখেছেন তন্ময় মোদক । ধন্যবাদ তন্ময়, আমার মতো অনেককেই তুমি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলে।