চার বছরের আমেরিকান গ্র্যাজুয়েট লাইফঃ কিছু ব্যর্থতা, হতাশা, এবং গ্লানির গল্প

Uncategorized

চার বছরের আমেরিকান গ্র্যাজুয়েট লাইফঃ কিছু ব্যর্থতা, হতাশা, এবং গ্লানির গল্প
___________________________________________________________________

অনেকদিন ধরে কিছু চাপা দুঃখ, কষ্ট, কথাকে নিজের মধ্যেই অবদমিত করে রেখেছিলাম। আজকে ভাবলাম গ্লানিকে নিজের মধ্যে রেখে কি লাভ, তার চেয়ে বরং চীৎকার করে সবার সামনে উগরে দেই। আমরা সবাই সফলতার মুখরোচক গল্প শুনতে চাই, ব্যর্থতা যেন আমাদের নিকট অশোচ এর মত। তার কথা বলা দূরে থাক, নামও মুখে আনা যাবে না! এ এমনই ভয়ঙ্কর তেতো!

অনেকেই হয়তো আমার ডিপ্রেশনে পড়ে সুইসাডের গল্পের কথা জানেন। (আমি আমার আগের এক পোস্টে সবাইকে জানিয়েছি) তখন অনেকেই সেই পোস্টে কমেন্ট করেছিল ‘আপনার মতো এত সফল মানুষ এটা করতে গেলেন কেন’, ‘জীবন থেকে এত উচু প্রত্যাশা রেখে লাভ কি;। তাই আজকের এই পোস্টে আমি আমার ব্যর্থতা, গ্লানির গল্প শোনানোর পাশাপাশি এই প্রশ্নগুলার উত্তর খুঁজব। পোস্টটা বড় হবে, তাই সবাইকে ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি।

আমি আমেরিকায় আসি ২০১৭ সালের অগাস্ট এ। লুইজিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটিতে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্‌স’ এ পিএচডি প্রোগ্রামে জয়েন করি। আমার এডভাইসর ছিলেন বুলগেরিয়ান এক ভদ্রলোক (সঙ্গত কারনে নাম উল্লেখ করছি না)। তো শুরুতে আমার পুরো সাপোট ছিল না (আমাকে ভার্সিটির ‘ইন স্টেট টিউশান’ দিতে হত)। এভাবেই প্রথম সেমিস্টার আমি নিজের টাকায় পড়ছি। এরই মধ্যে আমি ল্যাবে সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করতাম, এমনকি কোন কোন রবিবারেও কাজ করেছি! (নিজের টাকায় পড়ার সত্ত্বেও)। তো প্রথম সেমিস্টার শেষে আমার এডভাইসর আমাকে রিসার্চ এসিস্টেন্টশিপ অফার করে। আমিও খুব খুশি হলাম, ভাবলাম যাক এতদিনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। কিন্তু জীবন যে আমাকে অন্যরকম এক বাস্তবতায় ফেলতে যাচ্ছে সে কথা কে জানত।

এরই মধ্যে এক ব্যাচমেটের সাথে আমার ব্যক্তিগত মনমালিন্য শুরু হয় (আমি লক্ষ্য করলাম, সে সবকিছুতে আমাকে ছোট প্রমান করে)। সেই ব্যক্তিগত মনমালিন্য একসময় আক্রোশে পরিনত হয়। একদিন তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে সে আমার বাসায় পুলিশ কল করে, এবং পুলিশ এসে আমাকে হ্যারাজ করে। সঙ্গত কারনে বিষয়টি আমিও ভালোভাবে নেয় নি, এবং তার সাথে সম্পর্ক ওখানেই শেষ হয়। এরপর যা ঘটল, তথা আমেরিকার শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটা ভাষাচিত্র আমি অঙ্কন করছিঃ

এই ঘটনার পর বাঙালি কমিউনিটির মানুষজন আমাকে ভালো চোখে দেখত না (আমি জানি না সে তাদেরকে প্রভাবিত করেছে কিনা)। আমাকে কোন অনুষ্ঠান, দাওয়াতে ডাকা হতো না। আমাকে এরোগেন্ট, বেয়াদব প্রমুখ তকমা দেওয়া হল। সব ধরনের গ্রুপ থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হলো এবং গ্রুপে আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হতো (যেমনঃ আমার সম্পর্কিত কোন কিছু বললে বলত ‘অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে যা হয় আর কি’!)। ধীরে ধীরে আমি একটা টক্সিক পরিবেশের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম না, আমার একজনের সাথে সমস্যাটা ধীরে ধীরে সবার সমস্যার পরিনত হল কেন!

প্রথম দিকে কষ্ট পেলেও আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। এতকিছুর মধ্যেও প্রথম দুই বছরের মধ্যে আমি পিএচডির সব কোস কম্পিলিট করলাম, প্রথম বছরেই পিএচডি কোয়ালিফাইয়িং এক্সাম এ ডিপাট্মেন্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করলাম। কিন্তু ভাগ্য বোধ হয় আমার সহায় ছিল না। কোয়ালিফাইয়িং এক্সাম এর পরের সেমিস্টারে আমার মানসিক স্বাস্থ্য এর ভয়াবহ বিপর্যয় শুরু হয় এবং আমি একসময় আমি সুইসাইডের মতো ভয়াবহ প্রদক্ষেপ নেয়। এরপর আমি দুই সপ্তাহ ‘সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ড; এ থাকি, এবং ডায়গোনসিস করে জানা গেল, আমি দীর্ঘদিন যাবত ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন এবং অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅডার এ ভুগছি। আমি আমার মানসিক স্বাস্থ্য এর জন্য উপরের ঘটনাগুলাকে এককভাবে দায়ী করছি না, কিন্তু এই ঘটনাগুলার যথেষ্ট প্রভাব ছিল (আমার মানসিক স্বাস্থ্যএর ইতিহাস আমি একটু পরে বলছি)।

আমি সবচেয়ে বেশি আঘাতটা পেয়েছি আমার মানসিক স্বাস্থ্য এর বিপর্যয় এর পর। এত বড় ঘটনার পর কমিনিউটির কেউ আমার অবস্থার খোঁজ নিতে আসে নাই, আমার সাথে কমিনিউটির কেউ কথা বলত না! উলটো এক শ্রদ্ধেয়(!) বড় ভাই (আমার রুমমেট) বলল ‘আরে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅডার তো বাংলাদেশের সবারই আছে, এ আর এমন কি, কাজ করো সব এম্নিতেই ঠিক হয়ে যাবে! একদিন দেখলাম বাসায় হাসপাতালের বিল আসছে (চার হাজার ডলার)। তো সে বড় ভাই বলে উঠল ‘নিজের পাছায় বাঁশ দেওয়ার কাজটা খুব কম লোকই পারে, সেটা তুমি পেরেছ! আরেক বড় ভাই এই স্ত্রী আমার মানসিক অসুখকে অভিশাপ না দিলেও “রুহের হায়’ বা “Revenge of Nature” বা আরবিতে “কিফারাহ্ বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কমিউনিটিতে প্রচার করতে লাগলেন! এ হল একজন মানসিক অবসাদে ভোগা লোকের প্রতি তোমরা যাদেরকে দেশের রত্ন বলো তাদের অভিব্যক্তি!

যাই হোক নিজের কথায় ফিরে আসি। মানসিক অবসাদে ভোগার ফলশ্রুতিতে সেই সেমিস্টারে আমার একাডেমিক রেসাল্ট খারাপ হয়। আমি একডেমিক প্রবেশনে পড়ি (আমেরিকায় গ্রাজুয়েট স্টাডিতে কোন সেমিস্টারে জিপিএ ৩.০ এর নিচে পেলে, মানে ৮০% এর নিচে নম্বর পেলে তাকে একডেমিক প্রবেশনে রাখা হয়)। একডেমিক প্রবেশন এ পড়লে ফান্ড বাতিল হয়ে যায়, পরের সেমিস্টারে একডেমিক প্রবেশন উতরাতে না পারলে প্রোগ্রাম থেকে ‘ড্রপ আউট’ হতে হয়! আমারও তাই হল, ফান্ড বাতিল হয়ে গেল! আবারো নিজের টাকায় পড়তে লাগলাম! একে তো মানসিক সমস্যা, তার উপর এবার যোগ হল একডেমিক সমস্যা। এর মধ্যে কিন্তু আমার ল্যবে যাওয়া থেমে নেই। মানসিক সমস্যার কারনে আমি ভালোভাবে কাজে মন দিতে পারছিলাম না, ফলশ্রুতিতে রিসার্চ খুব ধীরগতিতে এগোতে লাগলো। শুরু হল এডভাইজরের অভিযোগ। বুঝতে পারলাম আমার মানসিক সমস্যার কারনে আমাকে নিয়ে উনি সংশয়ে ছিলেন। প্রায়শই যথাসময়ে কাজ করতে না পারলে উনি রীতিমত অপমান করতেন। একদিন চূড়ান্ত অপমানের পর, দুই বছর ধরে নিজের মানসিক সমস্যা নিয়েও কাজ করার পর যখন তার মুখে  ‘You screwed up my project’ এই লাইনটা শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। চিৎকার করে বলে দিলাম ‘I don’t want to screw up your project anymore. I am not going to work for you anymore. Good Bye!’. দুই বছর ধরে করা পিএচডি আর হল না, আমি এ বোধ হয় একমাত্র অধম যে পিএচডি কোয়ালিফাইয়িং এক্সাম সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করেও পিএচডি শেষ করতে পারে নি! পরেরদিন ডিপাট্মেন্টাল ডীন এর সাথে আলোচনা করে ঠিক করলাম পরের সেমিস্টারে মাস্টারস নিয়ে চলে যাবো। ডীন বার বার করে বলল অন্য প্রফেসরের আন্ড্রারে পিএচডি কন্টিনিউ করতে। বললাম No sir, I have made up my mind!

সমস্ত কষ্টগুলা এখানে শেষ হলে ভালোই হত। কিন্তু বিধাতা যে এখনো আমাকে আরো অনেক কিছু দেখাবেন বলে ঠিক করে রাখছেন সেটা কে জানত! এরইমধ্যে খবর পেলাম আমার ভার্সিটির এক ছোট ভাই এখানে পিএচডি করতে আসছে। সে শুধু আমার ভার্সিটির ছোট ভাই এ নয়, তাদের একটা পুরো ব্যাচকে দেশে থাকতে জিআরই এর জন্য আমি মেন্টরিং করেছিলাম। তো আমি খুব খুশি হলাম, ভাবলাম কথা বলার কেউ তো আসলো। তাকে আমার এই মানসিক এবং একাডেমিক সমস্যার মধ্যেও এয়ারপোট থেকে আনতে যাওয়া, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, সে আর আমি একসাথে থাকবো বলে নতুন বাসা খোঁজা থেকে শুরু করে, তার প্রাথমিক সব কাজ করলাম। কিন্তু বিনিময়ে যা পেলাম সেটার জন্য মোটেই আমি প্রস্তুত ছিলাম না! আমার ডিপ্রেশনের জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে এন্টিডিপ্রেশেন্ট নিচ্ছিলাম, এন্টিডিপ্রেশেন্ট এর সাইড ইফেক্ট এর জন্য আমার ঘুম ঘুম লাগতো, সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারতাম না। তো কিছুদিন পর দেখি সে আমার লাইফস্টাইল নিয়ে চরম অসন্তষ্ট। এমনকি আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে আমি যে সকালে ল্যবে যায় না, ঘুমিয়ে থাকি (আমি কি জন্য ঘুমিয়ে থাকি যদি সে জানতো!) এর জন্য আমার সুপারভাইজার আমাকে যে টাকা দেয় (আমার সুপারভাইজার এর সাথে আগের সেমিস্টারে বিবাদ হয়ে গেছে, এক সেমিস্টার হলো আমি নিজের টাকায় পড়ি) সেটা হারাম, সেটা আমার হক না, এরকম আরো অনেক কথা। এমনকি একদিন সে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে দেখি তার বাসায় আমাকে নিয়ে এইসব কথা বলছে! সেদিন তাকে ডেকে আমি আমার দুই বছরের ইতিহাস বলি, এবং আমার একাডেমিক অবস্থার কথা জানাই। কিছুদিন পর বাঙালি কমিনিউটিতে আমার ফান্ড বাতিল হয়ে গেছে, এবং আমি প্রোগ্রাম ছেড়ে দিচ্ছি এটা নিয়ে কানাঘুষা, এবং তুমুল হাসাহাসি শুরু হল। আমার বুঝতে বাকি রইলো না আর। কোন জুনিয়র যদি আমাকে চড়ও দিত এত অপমানিত হতাম না, সেদিন যত হয়েছিলাম!

সেই সেমিস্টারে পর আমি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টারস নেয়, এরই মধ্যে গণিত বিভাগের একজন প্রফেসর আমার পিএচডি এর কোসওয়াক দেখে (যার মধ্যে অনেক ম্যাথ এর কোস ছিল) বলে তুমি পিএচডি না করলে তো এতগুলা ক্রেডিট শুধু শুধু নষ্ট হবে। তুমি চাইলে আরেকটা ম্যাথ কোস নিয়ে আমার আন্ডারে থিসিস করে ম্যাথ এ মাস্টারস করে ফেলতে পারো। আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়। তাকে বলি ওকে প্রফেসর আমি এখন দেশে যাচ্ছি, এই সেমিস্টারটা ছুটি নিচ্ছি, দেশ থেকে এসে আমি আপনার আন্ডারে কাজ শুরু করবো।

দেশ থেকে ফিরে গিয়ে আমি যা দেখলাম সেটা ছিল আমার জন্য হয়তো কফিনে শেষ পেরেক! আমার বাসার মালিকের ইচ্ছে হলো সে সেখানে কমপ্লেক্স বানাবে, সে তার সমস্ত ভাড়াটিয়াকে একটা কম্পেনশেশান, এবং বাড়ি খালি করার নোটিশ দিল। এ কথা ঘুনাক্ষরেও আমার আদরের ছোটভাইটি আমাকে জানায় নাই। হঠাত দেশে থাকা অবস্থায় একদিন তার একটা ম্যাসেজ পেলাম ‘I moved to a new apartment, please find a place for yourself to stay। এটা লিখে সে তার দায়িত্ব শেষ করল। বলা বাহুল্য, আমার এক ঘর জিনিসপাতি, আমার সব একাডেমিক বই, সব একাডেমিক সার্টিফিকেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স সব বুলডোজারে তলিয়ে গেল! আর বাসার ডেপোজিট এবং কম্পেনশেশান এর টাকা সেটা আমার ছোট ভাইটি আমি তাকে ইদের সেলামি দিছি বলে মনে করলো! তো ছোট ভাইয়ের বন্ধুরা, তোমরা এইবার দেশে যখন গেলাম, তখন যখন বললা ভাইয়া আমাদের সাথে দেখা করেন নাই কেন, এর উত্তর তোমরাই দাও!

যাই হোক নিজের কথা বলি। দেশ থেকে ফিরে গিয়ে সেই সেমিস্টারে আমি গণিতে মাস্টারস নিয়ে লুইজিয়ানা টেকে আমার যাত্রা শেষ করি।

এত বিড়ম্বনা, গ্লানি, প্রতিকূলতার পরও আমি বর্তমানে ‘বেইলর ইউনিভার্সিটিতে’ ‘মহাকাশ বিজ্ঞানে’ আবার পিএচডি শুরু করছি গত বছর অগাস্ট এ। যদিও আমার প্রোগ্রাম শুরু হয়েছিল অগাস্ট এ, আমি এখানে জুনে চলে এসে ল্যাবে জয়েন করি যাস্ট ঐ টক্সিক পরিবেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। এবং এখানে ভর্তির সময় আমি একটা সাহসী পদক্ষেপ নিলাম। ইন্টারভিও এর সময় আমাকে যখন নিজের সম্পর্কে বলার জন্য বলা হল, আমি বললাম আমি এখানে আমার একাডেমিক অর্জন নিয়ে কিছু বলবো না, সেটা আপনাদের সামনে আছে, আমি বরং আজকে আপনার যেটা জানেন না সেটা বলি, আমি আসলে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, এবং Obsessive Compulsive Disorder এর রোগী। সুতরাং মাঝে মাঝে আমার Depressive episode এর সময় আমার কাজ up to the mark নাও হতে পারে। এও জানি, বর্তমানে আমার স্ট্যাডি যেহেতু শেষ আমেরিকায় আমার Legal Status ও শেষ। যেহেতু আমি জব করবো না, আমি OPT নেয় নাই। হয়তো কিছুদিনের মধ্যে আমাকে ল্যাগেজ গুছিয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। এবার আপনারাই সিদ্ধান্ত নেন এই রিস্কটা আপানার নিতে রাজি কিনা! Interview committe বললো, ওকে আমরা তোমাকে জানাবো। পরেরদিন এ Baylor থেকে অফিসিয়াল অফার লেটার পেলাম, যেটাতে লেখা ছিল We are very delighted to have a student as frank and honest like you. We respect the bold decision you have made for your career. Welcome to Baylor!’

জীবনে শুরু হল আরেকটা নতুন অধ্যায়। এখানে ভালোই আছি। নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছি। সেই সাথে দীর্ঘ চার বছর ধরে ডিপ্রেশনের সাথে লড়ে যাচ্ছি। সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকে গিয়ে জীবনের এক নতুন মানে ফিরে পেয়েছি। যাই হোক, নিজের জন্য বাচবো। আর  Depressive Episode এর সময় আমি সবচেয়ে বেশি মনে করি আমার মাকে, যে আমি না থাকলে, নিজেকেই শেষ করে দিবে।

প্রতিনিয়ত আমরা কত কিছুর সাথেই না লড়ি। কিন্তু নিজের সাথে লড়া মনে হয় সবচেয়ে কঠিন। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের জীবনটা আর পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো হয় না। আমরা সারাক্ষন নিজের সাথে লড়ে যায়। এই লড়াই নিজের অস্তিত্বের, এই লড়াই নিজের জন্য, নিজের প্রিয়জনদের জন্য। আমি দীর্ঘ ৪ বছর ধরে লড়ে যাচ্ছি, জানি না শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারবো কিনা। মাঝে মাঝে আমি রিয়ালিটির সাথে টাচ হারিয়ে ফেলি, মাঝে মাঝে মনে হয় সময় থমকে গেছে। এতকিছুর পরও রাতে ঘুমাতে গিয়ে মনে হয় পরেরদিন নতুন একটা সুন্দর সকাল আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেই আশায় বাঁচি!

বলাবাহুল্য, ঘটনাপ্রবাহে মানুষের উপর আমার আবেগ, অনুভুতি সব চলে গেছে। এখন মানুষজন দেখলে নিজের অস্বস্তি লাগে। তাই এখন কারো সাথে তেমন মিশি না, কথা বলি না। আমার মায়ের কাছে শুনেছি এজন্য অনেকেই নাকি বলে ‘আমি কেমন কেমন’। নতুন জায়গায় আসছি, তাই তোমরাও হয়তো ভাবতে পারো আমি আমি কেমন কেমন, তোমাদের সাথে তেমন মিশি না। তোমাদেরকেই বলছিঃ

১। আমি কেমন কেমন কারন, তোমরাই আমাকে কেমন কেমন বানিয়েছ।
২। আমি কেমন কেমন কারন, কারন তোমাদের সমাজ বলে ছেলেদের কাঁদতে নেই, এমনকি ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গেলেও, কান্না করা কাপুষরতার লক্ষন।
৩। আর আমেরিকার শিক্ষিত সমাজকে বলছি,কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে আমার সাথে কথা বলো’ এইসব রংদেখানো, বালের কথাবার্তা বলে চুতিয়াপনা, হিপোক্রিসি ছড়েন। অন্তত আর কিছু না পারেন, মানুষের বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাকে জাজ করিয়েন না। একটা আপাতদৃষ্টে স্বাভাবিক মানুষের ভিতের যে পাহাড়সম গল্প, গ্লানি, লড়াইয়ের ইতিহাস লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আপনার কল্পনাতীত!

দুই ঘন্টা ধরে এই লেখাটা লিখছি। আমার প্রিয় ডাল, আর বেগুন ভাজি করছি। আজকে তেমন ঠান্ডা নেই। খেয়ে একটু হাঁটতে বের হব। রাতে নির্জন রাস্তায় একা একা হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে। ডিপাট্মেন্টের সামনে বড় গাছটার পাদদেশে বসে চাওয়া, পাওয়ার অনেক হিসেব মেলাবো, অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখনো বাকি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *