চৈতি চন্দ্রিকা ওর নাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রী পাওয়া ঝকঝকে এক তরুণী।

Uncategorized
চৈতি চন্দ্রিকা ওর নাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রী পাওয়া ঝকঝকে এক তরুণী।
চৈতি চন্দ্রিকা যার নাম, আন্দাজ করা যায়, এই নামের মানুষটি মন ও মননে নিশ্চয়ই আধুনিক।
চৈতি চন্দ্রিকার সাথে আমার পরিচয় নেই, তবে ফেসবুকে হাজার হাজার বন্ধুর মাঝে থাকার কারণেই কারো না কারো ওয়ালে অথবা আধুনিক মনা মেয়েদের লেখায়, স্ট্যাটাসের কমেন্টে চৈতি চন্দ্রিকা নামের উপিস্থিতি মনে হয় লক্ষ্য করেছি।
কিন্তু গতকাল থেকে ফেসবুকে ঢুকলেই চৈতি চন্দ্রিকা নামটা চোখের সামনে চলে আসছে।
 চৈতি চন্দ্রিকা নামের তরুণীটি ক্রিসমাসের পরদিন মারা গেছে। মারা গেছে বললে ভুল হবে, কারণ ‘মারা গেছে’ শুনলে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হয়। আর ঘরের ফ্যানের আংটায় ঝুলে মারা গেলে সেটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয় না।

ফেসবুকে মৃত্যু সংবাদ আমি এড়িয়ে যাই, আর মৃত্যু সংবাদ যদি কম বয়সী কাউকে ঘিরে চলতে থাকে, আমি দুই চোখ দুই কান বন্ধ করে রাখি। 
আর মৃত্যু যদি অস্বাভাবিক হয়, আত্মহত্যা অথবা হত্যা, তেমন সংবাদ নজরে এলেই আমি অসুস্থ বোধ করি। 
মৃত্যু যতোই অমোঘ সত্য হোক না কেন, একবার মরে গেলে এই পৃথিবীতে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। 
তাই বল প্রয়োগ করে কারো প্রাণ কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে জানলেই আমার বুক ব্যথা করে, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করি!
তারপরেও চৈতি চন্দ্রিকার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন জনের লেখা পোস্টের দিকে নজর গেলোই।  তখনই জানলাম, চৈতির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। কারণ চৈতির দেহ ফ্যানের আংটা থেকে ঝোলানো ছিলো।
ফ্যানের আংটায় দেহ ঝোলানো থাকলেই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত সেই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা যায় না।
 অনেক সময় বাইরে থেকে কাউকে হত্যা করেও থানা পুলিশের ভয়ে মৃত্যুটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য হত্যাকারী মৃত দেহের গলায় গামছা/ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের আংটায় অথবা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়।
ফেসবুকে চৈতি চন্দ্রিকার বন্ধুরা নিশ্চিত নয়, চৈতির বেলায় কী ঘটেছে। আত্মহত্যা নাকি হত্যা?
সাধারণত কিশোরী মেয়েরা আত্মহত্যা করে  প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, এসএসসিতে খারাপ রেজাল্ট হলে অথবা পাড়ার বখাটেদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে। 
কিছু মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সামাজিক লাঞ্চনার শিকার হয়ে, ধর্ষণের শিকার হলে।
 আজকাল কিছু কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মেয়েদের বিয়ের পর। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বিরূপ পরিস্থিতিতে মেয়েদের স্বপ্ন ভঙ্গ হলে অথবা স্বামীর কাছে/ শ্বশুর বাড়ির স্বজনদের কাছে নিগৃহীত হতে থাকলে। 
কিছু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ডিপ্রেশন থেকে, সমাজ সংসার বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও মৃত্যুচিন্তা ভর করে!
চৈতি চন্দ্রিকার বেলায় উপরের কোনোটিই ঘটেনি। সকলের লেখা পড়ে জেনেছি, চৈতি চন্দ্রিকা নামের মেয়েটি সত্যিই আধুনিক মনের মানুষ ছিলো। হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েটির প্রচুর বন্ধু ছিলো। 
সে লেখাপড়ায় মেধাবী তো ছিলোই, ফেসবুকে পোস্টগুলো ফলো করলেই বোঝা যায় সে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী ছিলো।
তবে, চৈতির খুব কাছের বন্ধুরা লিখেছে,  চৈতির পারিবারিক জীবনটা সুখের ছিলো না। 
না, শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত কোনো বিষয় নেই এখানে। কারণ  চৈতি অবিবাহিত ছিলো। 
মা, মায়ের দ্বিতীয় স্বামী, ছোটো বোন আর চৈতিকে নিয়েই পরিবার। তাই পারিবারিক জীবনে সুখ অসুখও এই কয়জন ঘিরেই থাকার কথা।
চৈতির বন্ধুদের কেউই বিশ্বাস করছে না, চৈতি আত্মহত্যা করেছে! 
বন্ধুরা বলছে, ওর মানসিক কষ্ট ছিলো, ওর প্রতি মা আর ছোটো বোনের আচরণ অসহ্য ছিলো , তাছাড়া চাকরি পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং হতাশা ছিলো। 
এর জন্য চৈতি আত্মহননের পথ বেছে নেবে, তা হতেই পারে না!
আগের দিন চৈতি তার এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে সব বন্ধুদের সাথে মিলে অনেক আনন্দ করেছে। বাড়ি ফিরে ফেসবুকে বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসবের ছবিও আপলোড করেছে। নব বিবাহিত বন্ধু দম্পতির সাথে তোলা ছবি কভার পিকচারে দিয়েছে।
মনে আনন্দ থাকলেই তো এতসব করা যায়। মুখে চেহারায় হাসিতে সাজসজ্জায় এত আনন্দ নিয়ে কেউ গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফ্যানের আংটায় ঝুলতে চায়?
[ চৈতির সাথে ওর মা আর ছোটো বোনের সম্পর্ক কত খারাপ হতে পারে! মায়ের সাথে মেয়ের সম্পর্ক কেন খারাপ হয়! কখন খারাপ হয়!
চৈতির বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ীঃ চৈতির আসল নাম চৈতি সাহা। ওরা দুই বোন, চৈতি বড়ো। 
চৈতির বয়স যখন বারো-তেরো, চৈতির বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। দুই কন্যা নিয়ে চৈতির মা এরপর নতুন জীবন শুরু করে।
প্রথম স্বামীর সাথে সংসার সুখের হয়নি, তাই চৈতির মা দ্বিতীয় বার বিয়ে করে। 
এবার আর হিন্দু স্বামীর সংসার নয়, চৈতির মা মুসলিম বিয়ে করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। চৈতির ছোটো বোনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। 
তবে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর চৈতি কোন ধর্মীয় পরিচয় বহন করতো না। না হিন্দু, না মুসলমান।
মা আর ছোটো বোনের সাথে চৈতির অশান্তির শুরু এখানেই। 
চৈতির মা আর ছোটো বোন ওকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য প্রচন্ড চাপ দিতো। চৈতি তার মা আর বোনের প্রস্তাবে রাজী হতো না। তা নিয়েই নিত্যকার অশান্তি আর ঝগড়া।
** চৈতিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করতে ওর মা আর ছোটো বোনকে কে বা কারা চাপ দিতো, তা অবশ্য চৈতি কারো কাছে বলেনি। সত্য প্রকাশের কারণে  মা আর বোনের জীবনটা দুর্বিষহ হোক, এটা হয়তো চৈতি চায়নি। তার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয় মনে করেছে! **]
চৈতির মা পুলিশকে বলেছে, চৈতি মানসিক রোগী ছিলো!
চৈতির বন্ধুরা বলছে, চৈতিকে ওর মা আর ছোটো বোন প্রচন্ডরকম  মানসিক যন্ত্রণা দিতো। কিন্তু চৈতি মানসিক রোগী ছিলো না।
চৈতির নিথর দেহ হাসপাতালের মর্গে আছে, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আসেনি।
প্ররোচিত আত্মহত্যা হোক অথবা নির্যাতনে মৃত্যু হোক, বাস্তবতা হচ্ছে চৈতির মৃত্যু হয়েছে।
এই অকাল মৃত্যুর জন্য কেউ দোষী সাব্যস্ত হোক অথবা না হোক, চৈতি আর ফিরে আসবে না।
চৈতির মা পুলিশের কাছে নিজের কন্যার অপমৃত্যুর জন্য যতোই মেয়েকে মানসিক রোগী হিসেবে পরিচয় দিক, নিজের মনকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে?  
আমার বুকটা ব্যথা করছে। এত অবহেলায় এমন একটি তরতাজা প্রাণ চলে গেলো!
সন্তানের মনের অসুখটা হলো কেন, মনের অসুখ বাড়লো কেন— এই বিষয়ে যে মা সচেতন নয়, সে আসলে ‘মা’ নয়।
আমি ইচ্ছে করেই এখানে বাবা শব্দটা ইউজ করিনি। কারণ সন্তানের জন্মে একটি শুক্রাণু দান করা ছাড়া পুরুষের আর কোনো ভূমিকা থাকে না।
তাই সন্তানের জন্ম দিলেই পুরুষ বাবা হয় না।   
পুরুষকে দিনে দিনে, মাসে মাসে, বছরে বছরে, মুহূর্তে মুহূর্তে  ‘বাবা’ হয়ে উঠতে হয়।
চৈতি চন্দ্রিকার জন্ম হয়েছিলো প্রাকৃতিক  নিয়মেই, স্বামী-স্ত্রী নামক এক দম্পতির ঘরে। 
তবে চৈতির জন্মদাতা কখনোই ওর ‘বাবা’ হয়ে ওঠেনি, অথবা ‘বাবা’ হয়ে ওঠার জন্য যে নিষ্ঠা একাগ্রতা শ্রম সততা থাকতে হয়, তার কোনোটাই ছিলো না চৈতির জন্মদাতা পুরুষটির মধ্যে।
কিন্তু মা! নয় মাসের অধিক সময় নিজের গর্ভে একটি প্রাণ ধারণ এবং বহন করতে করতেই একজন মেয়ে ‘মা’ হয়ে ওঠে। মায়ের রক্ত মাংস হাড্ডি-গুড্ডি অস্থি মজ্জা দিয়েই সন্তানের দেহ মন তৈরি হয়। 
সন্তান তো আর কেউ নয়, সন্তান মায়েরই দেহ, মায়েরই আত্মা। এইজন্যই সন্তান ব্যথা পেলে মা ব্যথা পায়, সন্তান খুশি হলে মা খুশি হয়।
পদার্থবিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত চৈতি আর ফিরে আসবে না। চৈতির মায়ের কেমন লাগছে এটা ভেবে,  অথবা মানসিক রোগী মেয়ে নিজ থেকে বিদায় নিয়েছে ভেবে চৈতির মা স্বস্তিবোধ করবেন কি না, কে জানে! 
তবে আমার বুকের ভেতর হায় হায় করছে! আমিও তো মা, চৈতির বয়সী কন্যার মা।
প্রথম ছবিঃ ১৫ই ডিসেম্বর
দ্বিতীয় ছবিঃ ২৫ শে ডিসেম্বর ( বন্ধুর বিয়েতে, মারা যাওয়ার আগের দিন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *