জগতে সকলই জয় করা গেলেও,
আগ্রহহীন মূর্খের চিত্ত জয় করা কঠিন
জগতে মূর্খ শব্দটির সত্যিকার অর্থেই প্রকৃত সংজ্ঞা নেই।কিছু মানুষের দৃষ্টিতে যিনি মূর্খ, দেখা যায় বিশাল সংখ্যক একটি মানুষের কাছে তিনিই জ্ঞানী এবং আদরণীয়। এরপরেও আমরা মূর্খ শব্দটি প্রতিনিয়ত অন্যের প্রতি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি। শ্রীমদ্ভগবদগীতার সপ্তম অধ্যায়ে বিজ্ঞানযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘মূঢ়’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি যারা নিজের ভালমন্দ বুঝতে না পেরে মুক্তির পথে ভগবানের অগ্রসর হয় না তাদেরই তিনি মূঢ় বলেছেন।
ন মাং দুষ্কৃতিনো মূঢাঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াপহৃতজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:০৭.১৫)
“মূঢ়, নরাধম, মায়ার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং যারা আসুরিক ভাবসম্পন্ন, সেই সমস্ত দুষ্কৃতকারীরা কখনও আমার শরণাগত হয় না”
এই মূঢ়রা ভারবাহি গাধার মত অন্যের ভার বহন করে চলে। গাধা যেমন দিনরাত মনিবের ভার বহন করে চলছে, তেমনি কিছু মানুষেরা দিনরাত্রি সংসারের ঘানি টেনে চলছে। তেল তৈরির আধুনিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ ঘানিতে তিষি, তিল, সরিষা, ভেন্না প্রভৃতি হতে তেল তৈরি করত।
তেলের ঘানিতে চোখ বন্ধ করা একটা বা দুটি বলদ জুড়ে দেওয়া হত। বলদ নির্বিকার চিত্তে ঘানি টেনে যেত এবং তেল শস্যদানা থেকে তেল উৎপাদিত হত। দু’ঘা খাইবার ফলে বলদ চতুর্দিকে ঘুরিতে থাকিত। ঘূর্ণন গতিতে মেশিনের ভিতরে তৈলবীজগুলো তেল উৎপাদিত হত। বলদটি সারাদিন মনিবের জন্যে খেটেখুটে দেহ শেষ করে দিনশেষে কপালে জোটে দুমুঠো ঘাস অথবা খড়। অবশেষে বৃদ্ধকালে জরাগ্রস্ত হয়ে যেত তখন সারাজীবনের তার মনিবের প্রতি অবদান থাকার পরেও মনিব তাকে বিক্রি করে দেয়। বলদের সাথে মানব জীবনের চমৎকার মিল রয়েছে সংসারের পুরুষ মানুষের। স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-পরিজনরূপ সংসারের ঘানি টানতে টানতেই তাদের জীবন যৌবন কোথায় যে হারিয়ে যায় তা তারা নিজেরাও জানে না। যারা সংসারে হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম করে দুমুঠো অন্ন জোগাড়ে ব্যস্ত, বেঁচে থাকাই যাদের ধর্ম তাদেরই অকৃতজ্ঞ সমাজ “কলুর বলদ” বলে অভিহিত করে। ভক্তকবি রামপ্রসাদের সেনের সংগীতেও এ কলুর বলদের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়।তিনি তাঁর আরাধ্যা মাকে বলেছেন:
“মা, আমায় ঘুরাবি কত
কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত
ভবের গাছে জুড়ে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত।”
এভাবে ঘানি টানতে টানতে একদিন তাদের সম্মুখে মৃত্যু উপস্থিত হয়ে যায়; তখন আর কিছুই করার থাকে না।মূর্খের সাথে যখন আমরা চলি, মূর্খ সর্বপ্রথম তার আশেপাশের সবাইকে তার নিজের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। তার মধ্যে যদি গাধার প্রবৃত্তি থাকে, তবে আশেপাশের সবাইকে সে গাধাই মনে করে। মূর্খ বন্ধু থেকে জ্ঞানী শত্রুও উত্তম। তাই মূর্খ থেকে সর্বদা সাবধান থাকতে হবে, যথাসম্ভব দূরত্বে থাকতে হবে। মূর্খ অনেকটা আপেক্ষিক হয়, বিভিন্ন ব্যক্তি এবং ঘটনার সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে তাদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়।মূর্খ বিভিন্ন প্রকারের হয়:
১.স্বল্পজ্ঞানী
২. পণ্ডিতম্মন্য
৩. অজ্ঞানী
৪. মূঢ়জন
৫. অপরিনামদর্শী
প্রায় দুইহাজার বছর পূর্বে উত্তর ভারতের এক রাজা ভর্তৃহরি তিনটি শতককাব্য লেখেন। এগুলো হল- শৃঙ্গারশতক, নীতিশতক এবং বৈরাগ্যশতক। এর মধ্যে নীতিশতক গ্রন্থটি শুধুমাত্র ভর্তৃহরির নয় সংস্কৃত সাহিত্যেরও শ্রেষ্ঠগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম । এ গ্রন্থটি শুরু হয়েছে অজ্ঞজন বা মূর্খজনের প্রকৃত স্বরূপ বর্ণণা করে। যাতে মূর্খকে চিনে চিনে আমরা আমাদের প্রকৃত কর্তব্য অনুধাবন করতে পারি। ভতৃহরি বিভিন্ন প্রকারের মূর্খের বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রন্থটি শুরুই করেছেন স্বল্পজ্ঞানী মূর্খদের বর্ণনা দিয়ে। ভতৃহরির ভাষায়-
অজ্ঞঃ সুখমারাধ্যঃ সুখতরমারাধ্যতে বিশেষজ্ঞঃ।
জ্ঞানলবদুবিদগ্ধং ব্রহ্মাপি নরং ন রঞ্জয়তি।।
(ভর্তৃহরির নীতিশতক : ৩)
“যে অজ্ঞানী তাকে বোঝালে হয়তো বোঝে, প্রকৃত জ্ঞানীকে বোঝানো আরো অনেক সহজ, কিন্তু প্রসন্ন করা যায় না স্বল্পজ্ঞানে গর্বিত হয়ে যিনি নিজেকে পণ্ডিত মনে করেন তাকে, পিতামহ ব্রহ্মাও তাকে পরিতুষ্ট করতে পারেন না।”
এ স্বল্পজ্ঞানীরা যে জানে না, তা তারা নিজেরাও জানে না। কোন বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে না জেনেই তারা সবাইকে বিভিন্ন প্রকারের অকারণ জ্ঞান দিতে থাকে। পরিণামে পরিবার জীবনে এবং সমাজ জীবনে তারা প্রতিনিয়ত ঝামেলার সৃষ্টি করে।আগ্রহীন মূর্খের চিত্তের স্বরূপ বোঝাতে অসাধারণ দু’টি শ্লোকের অবতারণা করেছেন ভতৃহরি।আগ্রহহীন মূর্খের চিত্ত পাওয়া যে কত দুষ্কর তা তার শ্লোকের উপমায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে জাজ্জ্বল্যমান হয়ে উঠেছে।
প্রসহ্য মণিমুদ্ধরেন্মাকরবক্ত্রদংষ্ট্রান্তরাৎ
সমুদ্রমপি সন্তরেৎ প্রচলদূর্মিমালাকুলম।
ভুজঙ্গমপি কোপিতং শিরসি পুষ্পবদ্ধারয়ে-
ন্ন তু প্রতিনিবিষ্টমূর্খজনচিত্তমারাধয়েৎ।।
লভেত সিকতাসু তৈলমপি যত্নতঃ পীড়য়ন
পিবেচ্চ মৃগতৃষ্ণিকাসু সলিলং পিপাসার্দিতঃ।
কদাচিদপি পর্যটঞছশবিষাণমাসাদয়েৎ
ন তু প্রতিনিবিষ্টমূর্খজনচিত্তমারাধয়েৎ।।
(ভর্তৃহরির নীতিশতক : ৪-৫)
“কুমিরের মুখের যে দাঁত তার মধ্যে থেকেও হয়তো বলপ্রয়োগে মণি উদ্ধার করা যেতে পারে; চঞ্চল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সমুদ্রও হয়তো সাঁতরে পার হওয়া যেতে পারে; ক্রুদ্ধ সাপকেও হয়তো ফুলের ন্যায় মাথায় ধারণ করা যেতে পারে ; কিন্তু সন্তুষ্ট করা যায় না আগ্রহহীন মূর্খের চিত্তকে।
সযত্ন পেষণের ফলে বালুরাশি থেকেও হয়তো তৈল লাভ সম্ভব, সচেষ্ট হলে তৃষ্ণাতুর ব্যক্তিও হয়তো মরুমরীচিকায় জল পান করতে পারে, ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কখনও শিংওয়ালা খরগোসেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের প্রতি আগ্রহহীন মূর্খের চিত্ত কোনভাবেই পাওয়ার নয় অর্থাৎ মূর্খের মন হাজার চেষ্টা করেও কোনদিন জয় করা যায় না।”
তাই মূর্খজনকে আগে আপ্রাণ সংশোধনের প্রচেষ্টা করতে হবে। যদি সে সঠিক পথে চলতে না চায় তবে সেই সমাজ স্বীকৃত অজ্ঞ-মূর্খ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলাই শ্রেয়। কারণ জগতে মানুষ সবাই যে সকল কথা বুঝতে পারবে এমন নয়; এরজন্যে প্রারব্ধ কর্ম এবং পূর্বজন্মের সুকৃতিরও প্রয়োজন আছে। এ কারণেই আমরা সমাজ সংসারে দেখি কেউ দুধ বিক্রি করে, মদ কিনে খায়; আবার কেউ মদ বিক্রি করে দুধ কিনে খায়। কোন সাধুসজ্জনের ঘরে দুর্জন রাবনের জন্ম হয়, আবার দুর্জনের ঘরে ভক্ত প্রহ্লাদের জন্ম হয়। ভগবান প্রত্যেকটা জীবকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সে স্বাধীনতা দিয়ে যদি সে তার বুদ্ধির বন্ধ তালাকে খুলতে না পারে, তবে আর কিছুই করার নেই ; তাকে সমাজ-সংসারে ভাঙা কুলা হয়েই এককোনায় পরে থাকতে হবে। সমাজ সেই কুলাকে ব্যবহার করবে শুধুমাত্র ছাই বা ময়লা ফেলার সময়ে।
মূর্খরা অধিকাংশ সময়েই বুঝে হোক অথবা না বুঝে যে ডালে বসে থাকে, সেই ডালই কাটতে থাকে। কেউ তাদের সে সময়ে বারবার সতর্ক করলেও তারা তাতে কর্ণপাত করে না। অনেক সময়ে সঠিক সুপরামর্শদাতাকে শত্রু মনে করে। পরবর্তীতে যখন ডাল সমেত গাছ থেকে পরে যায় তখন আর কিছুই করার থাকে না ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়