# জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী
এই যে স্ক্রিনশট; ”ঘরে ঘরে দূর্গ তৈরি করো,” এই সাহসী আহ্বান একজন নারীর। তাঁর নাম ইতি চৌধুরী (Eity Chowdhury)। হিন্দুদের উপর পৈশাচিক আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে সারাদেশে এরকম বহু ইতি চৌধুরীকে এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব দেখেছি; বহু হিন্দু নারীকে রাজপথে মিছিলে দেখেছি। পুরুষরা সমাজে ও পরিবারে পাওয়ারফুল- মুক্ত বিচরণকারী। সুতরাং এই প্রতিবাদে পুরুষ হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি সন্দেহ নেই। আদতে কত শতাংশ হিন্দু বীরপুরুষ রাজপথে নেমেছেন জানি না। দেশের প্রায় দেড় কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠীর অর্ধেক পুরুষ। এই আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগের এক ভাগও যদি প্রতিবাদে যুক্ত হয়, যদি সবাই রাজপথে নেমে আসে তাহলে রাজপথ মানুষের বন্যায় ভেসে যাবে। সে প্রতিবাদ হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ সমাবেশগুলোর একটি। আসলে হিন্দু ”সাবালক পুরুষদের” প্রতি ১০০ জনের একজনও অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজপথে নামেনি; মুখও খোলেনি। দৃশ্যমান সত্য হল, আমাদের বোন -ইতি চৌধুরী -সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার প্রতিবাদে রাজপথ কাঁপিয়েছেন; কেবল ফেসবুক কাঁপানো নয়।
বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ এখনো একটি শিশু সংগঠন; আজ এর বয়স মাত্র দুই মাস ১২দিন। এখনো সারাদেশে আমাদের সংগঠন পূর্ণ অবয়বে গড়ে ওঠেনি। আমাদের সুসংগঠিত লোকবল এখনো তৈরি হয়নি। এর মধ্যেই আমাদের ইতি দিদি সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চট্টগ্রামে নারীদের সংগঠিত করে আমাদের সংগঠনের ব্যানার নিয়ে প্রায় প্রতিদিন মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন। হিন্দুসমাজের এই দুর্যোগে সারাদেশে এরকম বহু ইতি চৌধুরী এবার মিছিলে নেমেছেন।
তাহলে? সাহস ও শক্তিমত্তা কি শুধুই পুরুষের? আমাদের সামনে অনেক নারী আছেন; নেত্রী আছেন যারা হাজারো পুরুষের আশ্রয় দানকারী। বিপদে-আপদে বিভিন্ন এলাকার নারীনেত্রীদের কাছেই ছুটে যাচ্ছেন পুরুষের দল। নারী দুর্বল হলে, আশ্রিত হয়ে বেঁচে থাকাই তাদের নিয়তি হলে সমাজে ও পরিবারে এরকম শক্তিদায়িনী নারীরা কোথা থেকে আসছে? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতায়ন হলে নারীরাও প্রবল; নেতৃত্বে নারীরা পুরুষের সমান- এ কথা আজ প্রমাণিত। নারী এমপি হলে, মন্ত্রী হলে, কাউন্সিলর হলে, ম্যাজিস্ট্রেট হলে তার পেছনে পুরুষরা হাটে। নারী ধনী হলে পুরুষ তার মেষ চড়ানোর রাখাল হয়; গৃহপালিত স্বামী হয়; মেধাবী পুরুষরাও নারীর গোলামী করে। মূলকথা হল, মানুষের ক্ষমতা বা সামর্থ্য লিঙ্গপরিচয়ের উপর নির্ভর করেনা। এটা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অন্যান্য বাস্তবতার উপর। আপনি আপনার সমাজের নারীকে সেই ক্ষমতায় দেখতে চান কিনা- সেটাই আলোচ্য।
বিদ্যমান বাস্তবতায় সমাজের সাধারণ চিত্র হলো, পুরুষরা সর্বত্র একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী। নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে, আশ্রিত করে রাখা হয়েছে। হিন্দু পুরুষরাই পরিবারের কর্তা, তাদের হাতেই সম্পদ। গ্রামের মন্দির কমিটিতে পুরুষরাই থাকেন, এলাকায় যে বিচার-সালিশ বসে সেখানে পুরুষদেরই ডাক পরে; তারাই বিচার করেন। বিদ্যমান হিন্দু সমাজের অর্ধেক মানুষ লিঙ্গপরিচয়ের কারণে আশ্রিত হিসেবে ঘরে আছে এবং বাকি অর্ধেক তাদের পুরুষ-লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে সমাজের চালক হয়ে আছে। এই পুরুষরা স্বীকার করছে, তাদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু সমাজ আজ বিপন্ন। তবুও তাদের অনেকেই শক্তি বাঁড়ানোর প্রয়োজনে সমাজের বাকি অংশকে লড়াইয়ে সঙ্গে নিতে রাজি নয়। লড়াইয়ের উপাদানগুলো নারীদের হাতে তুলে দিতে, তাদের শক্তি জোগাতে, তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে, একক কর্তৃত্বশীলতা ছেড়ে দিতে এই ব্যর্থ পুরুষরা রাজী নয়। ইনিয়ে বিনিয়ে নানাধরণের মিথ্যাচার করে তারা নারীকে সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। অথচ কমনসেন্স থাকলেই বোঝা যায়, অসংখ্য ইতি চৌধুরী তৈরি হলে; ঘরে ঘরে নারীরা সমমর্যাদায় স্বীকৃত, শিক্ষিত ও ক্ষমতাধর হয়ে উঠলে হিন্দু সমাজের শক্তি দ্বিগুণ হবে। প্রচলিত সমাজ বাস্তবতা ডিঙিয়ে যেখানেই নারীরা এগিয়েছে সেখানেই সমাজ অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে।
দু:খজনক হলো এই হিন্দু সমাজের একদল নতুন ইজারাদার গজিয়েছে, যারা ধর্মের কথা বলে, কিন্তু ধর্ম মানেনা। তারা নারীশক্তিকে অবহেলা করে, নারীকে দুর্বল ভাবে। অথচ শাস্ত্র বলছে অন্য কথা। সনাতন হিন্দুশাস্ত্র বারবার দেখিয়ে দিয়েছে, যখনই দেবশক্তি পরাভূত, তখন দেবীশক্তির স্মরণ নেওয়া অনিবার্য। পুরাণে, রামায়নে এবং মহাভারতে কালে ও অকালে দেবীশক্তির বোধন হয়েছে। সনাতন ধর্মে দেবীর বোধন শুধুমাত্র মূর্তীতে নয়; বহুরূপে। জগৎসমাজে বহুরূপেই ঈশ্বরের প্রকাশ। যারা নারীশক্তিকে অবিশ্বাস করছে, তারা আসলে তাদের নিজেদের ধর্মকে অবিশ্বাস করছে। “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, ……….সর্বভূতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা” মন্ত্রকে তারা অবিশ্বাস করছে; অস্বীকার করছে। “সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানাং শক্তিভুতে সনাতনি” দেবী তারা বিশ্বাস করেনা।
ধর্মচ্যুত ঐ লোকগুলো সমাজে মাতৃশক্তির বিকাশের মাধ্যমে হিন্দুদের নবশক্তিতে দেখতে চায় না। এরা নারীকে সমসম্মানে দেখতে চায় না। এরা নিজ মায়ের অধিকারকে; গর্ভধারিনী স্নেহময়ী জননীর সন্মানকে পুরুষের পদতলে দেখতে চায়। এরা আপন সন্তানের প্রতি লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে বৈষম্য করতে কার্পণ্য করছে না। এরা কণ্যাসন্তানকে অধিকার বঞ্চিত করে নির্ভরশীল দাসী হিসেবে অন্যের ঘরে পাঠাতে কষ্টবোধ করে না। এরা আসলে ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে গোটা হিন্দু নারীসমাজকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আশ্রিত হিসেবে রাখতে চায়। তারা মনে করে নারীদের সম্পত্তিতে সমঅধিকার দিয়ে আইন পাস হলে তাদের বোনরা এসে সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে। এই ভয়ে স্বার্থলিপ্সু গ্রুপটি নানারকম মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাময় কথা বলে বেড়াচ্ছে। এরা নারীর ক্ষমতায়নে বাধা দিয়ে হিন্দু সমাজের প্রচন্ড ক্ষতি করছে। আমাদের ইতি দিদিরা নিজেদের ন্যায্য অধিকার দাবি করার মাধ্যমে মূলত: হিন্দু সমাজকেই শক্তিশালী করতে চাইছেন। এই ইতি দিদিদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। সন্তান হিসেবে মায়ের অধিকার রক্ষায় আমাদের দাঁড়াতে হবে। পিতা হিসেবে কন্যার সমঅধিকারের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে। ভাই হিসেবে বোনদের প্রতি অন্যায্যতা অবসানের দায়ভার আমাদের নিতে হবে। প্রিয়তমাকে নিজের সমমর্যাদায় স্বীকার করে হাজার বছরের পাপ মোচনে ব্রতী হও পুরুষ। তবেই হিন্দু সমাজ বাঁচবে।