জাতীয় ঐকমত্যের ৭ দফা দাবিনামা
১. ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্বশীলতা
(ক) জাতীয় সংসদে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যথাযথ অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষে যুক্ত নির্বাচনের (সার্বজনীন ভোটের) ভিত্তিতে ২০% হারে (৭০-র জনসংখ্যা অনুসারে) ৬০টি আসন সংরক্ষণ করতে হবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায়ও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(খ) সাংবিধানিক পদসহ প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বস্তরে, পররাষ্ট্র, পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সরকারি চাকরির সকল স্তরে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ন্যুনতম ২০% পদায়ন সুনিশ্চিত করতে হবে।
(গ) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণ নিশ্চিত করতে হবে এবং এ লক্ষে দেশের সব রাজনৈতিক দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি সাংগঠনিক কমিটির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অন্যুন ২০% হারে সংখ্যালঘু-আদিবাসীর অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে।
২. সাংবিধানিক বৈষম্য বিলোপকরণ
(ক) রাষ্ট্রীয় অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সম্পর্কীয় সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক ২ক অনুচ্ছেদের বিলোপ করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌল আদলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(খ) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারের ও পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।
(গ) ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ (ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ ঝধভবমঁধৎফ) সম্বলিত অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
৩. সম-অধিকার ও সমমর্যাদা
(ক) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও সমতলের আদিবাসীদের কল্যাণে ও উন্নয়নে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।
(খ) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কল্যাণে জাতীয় রাজস্ব বাজেট থেকে বার্ষিক বরাদ্দ প্রদান করে বিদ্যমান কল্যাণ ট্রাস্টসমূহকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তরিত করতে হবে এবং অনুরূপভাবে আদিবাসীদের জন্যও পৃথক ফাউন্ডেশন গঠন করতে হবে।
(গ) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষায় জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে।
(ঘ) সংসদ অধিবেশন, মন্ত্রীপরিষদের শপথ গ্রহণসহ রাষ্ট্রীয় সকল কর্মসূচি শুরুর পূর্বে সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঙ) ’৪৭ থেকে এ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে দেশের সংখ্যালঘু-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমানহারে হ্রাসের কারণ নির্ণয়নে ও তা রোধে সুপারিশ প্রদানের নিমিত্তে সংসদীয় কমিশন গঠন করতে হবে।
(চ) আদিবাসী ককাসের অনুরূপ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুবিষয়ক সংসদীয় ককাস গঠনে উদ্যোগ নিতে হবে।
(ছ) সকল ধর্ম ও স¤প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. স্বার্থবান্ধব আইন বাস্তবায়ন ও প্রণয়ন
(ক) পার্বত্য শান্তিচুক্তির দ্রæত বাস্তবায়নসহ এ চুক্তির আলোকে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে অনতিবিলম্বে তা কার্যকর করতে হবে।
(খ) সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যার নিশ্চিত সমাধানের নিমিত্তে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করে তাদের ভূমির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
(গ) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, দানের ঘোষণা সম্বলিত নিবন্ধন আইন ও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনের দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে।
(ঘ) দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে;
(ঙ) অধিকতর অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হরিজন, দলিত, ঋষি স¤প্রদায় এবং অবহেলিত চা-শ্রমিকদের পেশা ও ভূমির অধিকারসহ তথা সামগ্রিক কল্যাণে সকল প্রকারের সামাজিক বৈষম্য নিরসনে বিশেষ আইন প্রণয়নসহ নানাবিধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে শিক্ষিত হরিজন, দলিত, ঋষি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি কোটার মাধ্যমে নিয়োগের নিমিত্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য নিরসন
(ক) জাতীয় স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড প্রণীত ও অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকে দেশের সকল ধর্ম ও জাতিসত্বার সম-মর্যাদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
(খ) দেশের সকল বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ অপরাপর ধর্মীয় স¤প্রদায়ের ধর্মজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সকল পর্যায়ের ধর্মশিক্ষকের ক্ষেত্রে বেতন বৈষম্যের অবসান করতে হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, অনুদানে ও পরিচালনায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের সকল ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষায়তন চালু করতে হবে। সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ধর্মশিক্ষার বিদ্যমান শিক্ষায়তনগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে।
৬. দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ
(ক) ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
(খ) সংখ্যালঘু সুরক্ষাজনিত আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত দ্রæত বিচার আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনে শাস্তির বিধান বাড়িয়ে সা¤প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের দ্রæততম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে।
(গ) ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সংঘটিত সা¤প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলীর বিষয়ে গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশন রিপোর্টের সুপারিশমালার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(ঘ) সা¤প্রদায়িক সন্ত্রাসরোধে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সা¤প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ
যে কোন ধরনের সা¤প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, বর্ণবৈষম্য ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রোধে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
যথাযথ ক্ষমতায়ণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকরণসহ উলেখিত দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করা না হলে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হবে, যা কারও কাছে কাম্য নয়।