জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনকাল ও এক এগারোর দেজাভু

Bangladesh democracy Maskwait Ahsan

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশেষ মুহূর্তে একটি বক্তৃতা দিলেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি থেকে ফিরে আবার রহস্যজনকভাবে ছুটি নিয়ে কিছুদিনের জন্য বিদেশ যাওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। সেই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই বক্তৃতায় বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে গণতন্ত্রের জন্য তাঁর দৃঢ় ত্যাগ ও অঙ্গীকারের কথা বললেন তিনি।

উনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, কীভাবে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিচারপতিদের সম্মান ও বিচার বিভাগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের ভাষণটি আরেকটিবার শোনেন, উনি বুঝতে পারবেন কীভাবে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার আমলের বিচারপতিদের হেনস্থা করার ঘটনাগুলোর  পুনরাবৃত্তি ঘটছে বিদ্যমান বাস্তবতায় ।  

প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আগে একজন ব্যক্তির দক্ষতা-সততা-পেশাদারিতা বিবেচনা করা হয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এস কে সিনহা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনেই তাঁকে মনোনীত করেছিলো ক্ষমতাসীন সরকার। এস কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রায় দেবার পর থেকে রায় ও এর পর্যবেক্ষণে সংক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও তাদের সমর্থকেরা অশোভন ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। একটি রায় আর তার পর্যবেক্ষণ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খল নায়ক হয়ে যান আওয়ামী লিগের চোখে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন প্রধান বিচারপতিকে এমন আপত্তিজনক দলীয় রোষের সামনে পড়তে হয়নি।

এরপর ঠিক এক এগারোর সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেমন দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলো কয়েকজন ব্যক্তি, সেনানিবাসে ডেকে নেয়া আওয়ামী লীগের নেতারাই জিজ্ঞাসাবাদে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলো; ঠিক সেরকম একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হতে শুরু করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে।

রাষ্ট্রপতি পাঁচজন বিচারপতিকে বঙ্গভবনে ডেকে নেয়া; সেখানে পাঁচ বিচারপতি কতৃক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার ঘটনাটি ঠিক ষোড়শ সংশোধনীর রায় দেবার পরেই ঘটা; তার আগে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত না হওয়া; “ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে এস কে সিনহার রায় আর তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের” গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্দেশ করে।

কোন অভিযোগ নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হবার আগে পর্যন্ত তা কেবল অভিযোগ। কেবল অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচ বিচারপতির প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একই বেঞ্চে বসতে না চাওয়া; মাইনাস ওয়ান ফর্মূলার রাজনীতিক শেখ হাসিনার সঙ্গে এক দেশে থাকতে না চাওয়ার মতোই অলীক এক আবদার। অপরাধ প্রমাণিত হবার আগেই শেখ হাসিনাকে দেশে প্রবেশে বাধা দেয়া; আর অপরাধ প্রমাণিত হবার আগেই “ছুটি থেকে ফিরে এস কে সিনহা আবার ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়া এবং এটর্ণি জেনারেলের মন্তব্য, ফিরে এসে উনার দায়িত্ব নেয়া সুদূর পরাহত” একটি দুঃখজনক সাদৃশ্য মেলে ধরে। তার মানে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার মত শেখ হাসিনাও বিচারপতি ও বিচার বিভাগ নিয়ে খেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন কীনা! গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তাঁর বিশিষ্টতা হারাচ্ছেন কীনা এই আত্মজিজ্ঞাসা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে বলেই মনে হয়। প্রধান বিচারপতি বিদেশে যাবার আগে সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’

এটা অনস্বীকার্য যে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন; কিন্তু শাসন ব্যবস্থার একটি স্তম্ভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে তিনি ও তার সরকার নিরংকুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত তৈরী করলেন; তা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সার্বিক অর্জনে মালিন্য এনেছে।

এস কে সিনহা ও বিচার বিভাগ নিয়ে ঘটে যাওয়া কালো ঘটনাটিতে আইন মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এস কে সিনহা ক্যানসারে আক্রান্ত ও অসুস্থ; আর এস কে সিনহার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ; তথ্যের এই বৈপরীত্য এটা সূর্যালোকের মত স্পষ্ট করে তোলে; এস কে সিনহাকে নিয়ে সরকার খেলছে।

আর এই ঘটনাটি ঘটানোর পর এস কে সিনহা দেশ ত্যাগের পরপরই “ক্যানসার নয় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ”, টিভি টকশোতে এসকে সিনহার মিডিয়া ট্রায়ালের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাটি  তাঁর বক্তব্যের লাইনে লাইনে বর্তমান সময়টিকে যেন জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনকাল ও এক এগারোর দেজাভু করে তোলে। জিয়া-এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের কথা উনি যখন বলছিলেন; মনে হচ্ছিলো এই ঘটনাগুলো তো এখনো ঘটছে। খালেদা জিয়ার ভোটার বিহীন নির্বাচনের কথা উনি যখন বলছিলেন; তখন তা গত ভোটার বিহীন নির্বাচনের চিত্রকল্প মেলে ধরছিলো যেন। এইভাবে উনি যেন একই সঙ্গে অতীত ও বর্তমানকে তুলে ধরছিলেন। স্বয়ংসম্পূর্ণ বক্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি; যিনি অতীত ও বর্তমানের ভাষ্যকার। গণতন্ত্রের জন্য উনি যে অঙ্গীকারের কথা বলছিলেন; তা অতীতের মতো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি কিছুতেই।

বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে দুটি দৃষ্টান্ত ও পথ খোলা রয়েছে। অন সান সুচি ও আঙ্গেলা ম্যারকেল। গৌরবময় গণতান্ত্রিক নেত্রী অন সান সুচি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার হরণের সমর্থক হয়ে ইতিহাসের মলিন পৃষ্ঠায় চলে গেলেন। আর গৌরবময় নেত্রী আঙ্গেলা ম্যারকেল গণতন্ত্র ও সুশাসন উপহার দিয়ে ফেয়ার প্লের মাঝ দিয়ে ইতিহাসের উজ্জ্বল পৃষ্ঠায় সমাসীন রইলেন। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই বেছে নেবেন সঠিক দৃষ্টান্ত ও পথ সে প্রত্যাশা রইলো।

Maskwait Ahsan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *