জীবন দর্শনের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ

অন্যান্য

জীবন দর্শনের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ

  অগ্রসর বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম আজকাল ভোগবাদের স্থূল ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। জীবন ধারণের ক্ষেত্রে যতটুকু না হলেই নয়; ঠিক ততটুকু ব্যয় করছে তারা। বড় এপার্টমেন্ট বা বড় গাড়ি কিনে অযথা বেশী অর্থ লগ্নি করতে চাইছে না কেউ। একে মিনিমালিস্টিক এপ্রোচ বলা হচ্ছে।

একটা ছোট এপার্টমেন্টেই স্পেসকে কীভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়; সে চেষ্টা করছে নতুনেরা। গাড়ি না কিনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা ট্যাক্সিতে যাতায়াতের কাজ চালিয়ে নেয়াই বেশি যুক্তিসংগত মনে করছে  তারা। যাদের কাজ অনলাইন নির্ভর; তারা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। শুধু নতুন প্রজন্ম কেন; চাকরি থেকে অবসর নেয়া প্রজন্ম এখন গ্রামে বসবাসকেই বেছে নিচ্ছেন শান্তিপূর্ণ ও পরিবেশ বান্ধব জীবন যাপনের জন্য।

নতুন প্রজন্ম চলে আসা ক্লিশে জীবন দর্শন থেকে বেরিয়ে আসছে এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। আগের প্রজন্মে বড় গাড়ি-বড় বাড়ির পেছনে অর্থ লগ্নি করা লোকেরা সন্তানের আগামী নিশ্চিত করতে সন্তানদের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টা করতেন। এসব ব্যাপারকেই জীবনের সাফল্য ও নিরাপত্তার সূচক বলে ধরে নিয়েছিলেন তারা।

কিন্তু নতুন প্রজন্ম এসবকে ভুল চিন্তা বলেই চিহ্নিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের ভাবনাটা এমন, সন্তানকে ভালো শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের খানিকটা সুযোগ দিয়ে দিলেই যথেষ্ট; এরপর নিজের জীবন নিজেই গড়বে তারা। তাহলে বৈশ্বিক জীবন ভাবনায় যে পরিবর্তন আসছে তা কী কৃপণতার লক্ষণ!
ব্যাপারটা এমন নয়; এখন চিন্তার জগতে অগ্রসর মানুষেরা অধিকার বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে যথাসাধ্য অর্থ সাহায্য করে। আর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় ভ্রমণ করে। বড় বাড়ি-বড় গাড়ির নিরাপত্তা জনিত ঝামেলা থাকছে না। ফলে ছুটি পেলেই নানা আকর্ষণীয় জায়গা ভ্রমণে চলে যাওয়া যায় ছোট এপার্টমেন্টে তালা দিয়ে। অথচ আগের প্রজন্মে দেখা গেছে; বড় বাড়ির নিরাপত্তার চিন্তায় বয়েসী মানুষেরা অনেক জায়গা ঘুরতে যাবার শখ থাকার পরেও তা পূরণ করতে পারেনি; সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তায় টাকা জমাতে গিয়ে; নিজেদের জীবনের অনেক স্বাদ অপূর্ণ রয়ে গেছে।

এখন পশ্চিমের দেশগুলোতে বড় গাড়ি-বড় গাড়ির গ্রাহক পৃথিবীর অনুন্নত এলাকা থেকে আসা অভিবাসী মানুষের মাঝেই বেশি। তারা এখনো সেই অতীতের লাইফ-স্টাইল অর্জনের স্বপ্নের পিছেই দৌড়াচ্ছে। অথচ পশ্চিমের নতুন প্রজন্ম জীবনকে খুব সহজভাবে নিতে শিখেছে।  দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আরব বিশ্বে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বড় বাড়ি-গাড়ি-বসার ঘরের শানদার সাজসজ্জা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবার  চ্যালেঞ্জটাই জীবনে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়; সেসব মানসিক স্তর অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে অগ্রসর জনপদের মানুষেরা। পশ্চিমের দেখাদেখি অনুন্নত বিশ্বের ধনী লোকেরা ভ্রমণের বিষয়টিকে ট্রেন্ডি হিসেবে তুলে নিলেও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ভ্রমণে গিয়ে সবচেয়ে বেশি খরচ অনুন্নত জনপদের মানুষেরাই করে; কারণ তাদের ফেলে আসা গ্রামের মানুষকে দেখাতে হবে কত বিলাসী হোটেলে ছিলো তারা! অথবা তাদের ধারণাই নেই ভ্রমণ মানেই সবচেয়ে কম খরচে ঘুরে আসা।

এনলাইটেনমেন্ট বা চিন্তার জগতে আলোকায়ন থেকে মানুষ জীবনের সারবত্তা বা সাবস্ট্যান্স খুঁজতে শিখে গেছে। জীবনের গুণগত উৎকর্ষ সহজ ও সুখী জীবন যাপনের মাঝেই নিহিত থাকে। জীবন ধারণের জন্য কতটা অর্থ প্রয়োজন তার একটি হিসাব মনে মনে কষে ফেলতে পারে তারা; অযথা অর্থ উপার্জনের ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়ে জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলার বোকামি একবিংশ শতকে এসে কেনই বা করবে মানুষ। জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বা একচুয়ালাইজেশান এসে গেলে বাহিরী চটক নির্ভর “কে কী ভাবছে” বা ” প্রতিবেশীর সঙ্গে তুলনামূলক জীবন যাপন” কেন করবে আর মানুষ।

পশ্চিমা মিডিয়ার লাইফ স্টাইল নির্ভর প্রতিবেদন কিংবা ইউটিউবে এরকম মিনিমালিস্টিক (অল্পে তুষ্ট) সুন্দর জীবনের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের বিষয়গুলো প্রায়ই উঠে আসছে।  আশার বিষয়, এই অনলাইনের যুগে কে আর বই কিনবে এই চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দেখা যাচ্ছে; ছোট এপার্টমেন্টে একপাশে বই-পুস্তক রাখার একটি জায়গা থাকছে; জীবনের বাজেটে বই কেনা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।

পশ্চিমের মানুষ শিল্প-বিপ্লবের পর গজিয়ে ওঠা নব্যধনী বা ফিলিস্টাইন্সদের শো-অফে এতো ভুগেছে; এরপর জাত্যাভিমান ও সুপার ইগোজনিত যুদ্ধ বিগ্রহে ভুগেছে, আর্থিক মন্দা বা রিসেশানের অনিশ্চয়তায় ভুগেছে; এইসবের মাঝ দিয়ে জীবনের  অর্থ কী এই প্রশ্নের খুব স্পষ্ট  উত্তর পেয়ে গেছে নতুন প্রজন্ম। নতুন এই জীবন দর্শনটি যেন, টেক ইট ইজি, সব কিছুকে সহজভাবে নাও।

তাই এখনো অনুন্নত বিশ্বের নতুন প্রজন্মকে ” তাক লাগিয়ে দেয়া”, “সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া”, “পৃথিবীতে এই প্রথম”, ” আমরাই শ্রেষ্ঠ”, “ঝলসে ওঠা”, “এশিয়ার বৃহত্তম”, “হার মানতে জানি না” জাতীয় যেসব অগ্নিপরীক্ষার মাঝে সমাজ ফেলে রেখেছে; তাদেরকে এইসব অপ্রয়োজনীয় গ্রামীণ সামাজিক প্রত্যাশার চাপ ও ভারমুক্ত করে দেয়া খুবই জরুরী।
২০১৮ সাল আনন্দময় হোক সবার জন্য।

লেখক
মাসকাওয়াত হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *