জীবোদ্ধার : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও জগাই মাধাই

Blog অনুপ্রেরণা উপখ্যান গল্প জীবনী বাংলাদেশ ভারত সচেতনতা

পাঁচশ বছর আগের কথা বলছি। তখন জাতিভেদ বর্ণভেদ আমাদের সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর তলে দিয়েছিল। এই বিভেদ দূর করার জন্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সহজ করে দিলেন শ্রীগৌরাঙ্গ। এই শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীগৌরসুন্দরই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। তাঁর সহচর ছিলেন নিত্যানন্দ প্রভু। আরও ছিলেন শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, শ্রীহরিদাস, শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন, শ্রীজীব শ্রীগোপাল ভট্ট, শ্রীরঘুনাথ দাস প্রমুখ।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, কৃষ্ণনাম কর। নামে দেহ পবিত্র হবে, পাপ দূরে যাবে। শ্রীনিত্যানন্দ মেতে উঠলেন কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে।

মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ আর শ্রীনিত্যানন্দ জীবের কল্যাণের জন্য তাঁরা আকুল হয়ে যেতেন। পাপকে তারা ঘৃণা করতেন, কিন্তু পাপীকে নয়। তাই পাপীদের জন্য তাঁদের প্রাণ কেঁদে উঠত। তাঁরা তাঁদের উদ্ধারের উপায় খুঁজতেন।

নবদ্বীপে থাকা অবস্থায় শ্রীগৌরাঙ্গ একদিন প্রভু নিত্যানন্দ ও ভক্ত হরিদাসকে ডেকে বললেন, ‘জীবের উদ্ধারের জন্য তোমরা ঘরে ঘরে গিয়ে মধুর কৃষ্ণনাম প্রচার কর। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হরিনাম বিলাও।

“প্রতি ঘরে ঘরে এই কর গিয়া ভিক্ষা।

কৃষ্ণ ভজ কৃষ্ণ বল কর কৃষ্ণ শিক্ষা।”

জীবোদ্ধার : শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও জগাই মাধাই

প্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ গৌরসুন্দরের আদেশে নিত্যানন্দ ও হরিদাস নবদ্বীপের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কৃষ্ণনাম গান করতে লাগলেন। যাকে পান, তাকেই বলেন কৃষ্ণনামের কথা, ভজনের কথা।

সে সময়ে জগাই মাধাই নামে দুই ভাই নবদ্বীপে বাস করত। ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও মানুষের প্রতি অত্যাচার করা তাদের দৈনন্দিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা ছিল রাজকর্মচারী, কাজীর কোটাল বলে সবাই তাদের ভয় পেত। তাদের অত্যাচারে নবদ্বীপের লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। জগাই মাধাইয়ের অবস্থা শুনে এবং স্বচক্ষে দেখে নিত্যানন্দের প্রাণ করুণায় গলে। তিনি হরিদাসকে বললেন, “দেখ হরিদাস, হরিনামে যদি এদের উদ্ধার না হয়, তাহলে নামের শক্তি কিরূপে বোঝা যাবে? আর গৌরসুন্দর যে জীব উদ্ধারের জন্য অবর্তীণ হয়েছেন, তার প্রমানই বা কোথায় মিলবে?” হরিদাস নিত্যানন্দে কথা সমর্থন করলেন। উভয়ে পরামর্শ করে জগাই মাধাইয়ের কাছাকাছি গিয়ে কীর্তন শুরু করলেন

“বল কৃষ্ণ ভজ কৃষ্ণ কহ কৃষ্ণ নাম।

কৃষ্ণ মাতা কৃষ্ণ পিতা কৃষ্ণ ধন প্রাণ।।

তোমা সবা লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার।

হেন কৃষ্ণ ভজ সব ছাড় অনাচার।”

(চৈতন্যভাগবত)

এই কথা শোনামাত্র “তোরা কে রে?” বলে ভীষণ ক্ষিপ্ত জগাই মাধাই নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে তাড়া করল। তাঁরা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে গৌরসুন্দরের আবাসস্থলে পৌঁছে গেলেন। তখন জগাই মাধাই বিফল মনোরথ হয়ে সেদিনের মত ফিরে গেল।

হরিনাম করতে করতে একদিন সন্ধ্যার পর নিত্যানন্দ ফিরছেন মহাপ্রভুর গৃহের দিকে। হঠাৎ রাস্তায় জাগাই মাধাই তাঁকে ধরে ফেলল। নিত্যানন্দের মুখে হরিনাম শুনে দুভাই ভয়ানক ক্ষেপে গেল। তাদের এ অবস্থা দেখে নিত্যানন্দের হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল। তিনি তাঁদের দুর্গতি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। কিন্তু এতে পাষন্ড জগাই মাধাইয়ের মন মোটেই নরম হল না, বরং ক্রোধে তারা জ্বলে উঠল। মাধাই কলসির কানা কুড়িয়ে নিত্যানন্দের কপালে ছুঁড়ে মারল।

নিত্যানন্দের কপালকেটে রক্ত ঝরতে লাগল। সে অবস্থাতেও তিনি হরিনাম প্রচারের ইচ্ছা ত্যাগ করেননি। যেন তাঁর কিছুই হয়নি, এমনিভাবে তিনি জগাই মাধাইকে বললেন

“মারিলি কলসির কানা সহিবারে পারি।

তোদের দুর্গতি আমি সহিবারে নারি।।

মেরেছিস মেরেছিস তোরা তাতে ক্ষতি নাই।।

সমুধুর হরিনাম মুখে বল ভাই।।”

মাধাই পুনরায় তাঁকে মারতে উদ্যত হল। তখন জগাই তাকে হাতে ধরে বলল, “মাধাই করিস কি? কোথা থেকে সন্ন্যাসী এসেছে? তাকে কি মারতে আছে? তুই বড়ই নির্দয় রে”। এ সংবাদ শোনা মাত্র শিষ্যগণসহ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন গৌরসুন্দর। নিত্যানন্দের ঐ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। “দুষ্টকে বধ করলে উদ্ধার করব কাকে? ‘মোরে ভিক্ষা দাও প্রভু, এ দুই শরীর। আমি জীব দুটি নিয়ে তোমার পতিতপাবন নামের সার্থকতা রক্ষা করি। প্রভু, আমার কপালে যে আঘাত লেগেছে, এটি নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। সামান্য আঘাত লেগেছে। আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমার অভয় চরণে এই দুঃখী জীব দুটিকে স্থান দাও প্রভু।

তাছাড়া মাধাই মারলেও জগাই তাকে থামিয়েছে। শ্রীগৌরাঙ্গ সহাস্যে বললেন, “জগাইকে আমি ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু মাধাই তো নিত্যানন্দের নিকট অপরাধী। আমার ভক্তকে যারা কষ্ট দেয়, আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি না।

তখন নিত্যানন্দ গদ গদ কণ্ঠে প্রভুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি এ দুটি পাপীকে যে উদ্ধার করবে সে আমার অজানা নয়। তবে আমার গৌরব বাড়াবার জন্য আমার অনুমতির কথা বলছ। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, আমি মাধাইকে ক্ষমা করলাম। এই সঙ্গে আরও বলছি, যদি কোন জন্মে কোন সৎকর্ম কিছু করে থাকি, তার পুণ্যফল সবই আমি মাধাইকে দিলাম। তুমি এই পরম দুঃখী জীবটিকে চরণে স্থান দাও।” এই বলে নিত্যানন্দ মাধাইকে আলিঙ্গন করলেন, জগাইকেও তখন। আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন শ্রীগৌরাঙ্গ।

এ ঘটনার পর জগাই মাধাই হয়ে গেল নতুন মানুষ। কৃষ্ণ কৃষ্ণ, বলতে তাদের নয়ন থেকে ঝরে অশ্রুধারা- এমন সাধক হয়ে গেল জগাই মাধাই।।

হিতোপদেশ: পাপকে ঘৃনা কর, পাপীকে নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *