জৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠী, অরণ্যষষ্ঠী পালন করে হিন্দুু সম্প্রদায়।

Uncategorized
আজ জামাইষষ্ঠী। জৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠী অর্থাৎ অরণ্যষষ্ঠী পালন করে হিন্দুু সম্প্রদায়। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম আমার মামী আমের পল্লব তালপাতা বটের ডাল সিঁদুর ঘট বেলপাতা মধু করমচা আমলকি হরিতকী সুপারী দূ্র্বা কাঁচা হলুদ আরো অনেক কিছু দিয়ে কয়েক দিন ধরে উপকরণ সংগ্রহ করে লালসুতা দিয়ে বেঁধে একটা পেটমোটা সাপুড়ের বীণের মত তৈরি করতেন। আমাদের ভাই-বোনদের পুকুর ঘাটে নিয়ে প্রথমে স্নান করাতেন তারপর নতুন জামা কাপড় পরিয়ে ঐ গাাছ ভিজিয়ে জল ছিটিয়ে মন্ত্র পাঠ করে “বারো মাসে তের ষষ্টীতে আপদবালাইকে দূরে যাবার প্রার্থনা করে হাতে হলুদ মাখা লাল সুতা বেঁধে দিতেন মঙ্গল কামনায়। তারপর সকলের জন্য আলাদা আলাদা পিড়ি পেতে কাঁসার থালায় চিড়া দৈ খৈ আম কাঁঠাল শবরীকলা গুড় নারকোল কোরা দিয়ে মেখে  খেতে দিতেন। দুপুরে হতো নানান পদের খাবারের আয়োজন। আজ খুব মনে পড়েছে কারণ জামাই আসেনি। আসতে পারেনি। মেয়েটার আসা হলো না। ছেলে- বৌমা চলে গেছে কদিন আগে। কাছে নেই আমার দৃশ্যায়নাও।  লোকাচার মতে, দিনটা ছিল আর পাঁচটা ষষ্ঠীর মতোই। যেদিন সন্তানের মঙ্গলকামনায় মায়েরা ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করতেন, ব্রত পালন করতেন। কোত্থেকে যেন এই জষ্ঠি মাসের ষষ্ঠীতে সন্তানের সঙ্গে জুড়ে গেলেন জামাইরাও! আর ধীরে-ধীরে এই ষষ্ঠীর নামই পালটে গেল জামাই ষষ্ঠী তে। আর সেই সুযোগে ভরা জৈষ্ঠ্য মাসে চড়া রোদ মাথায় নিয়েই জামাই বাবাজিরাও শ্বশুরবাড়ি মুখো হলেন। জামাই বলে কথা, তাঁকে যত্ন আত্তি না করলে চলে! শাশুড়ি মাও তাই ঘাম ঝরিয়ে শুরু করলেন রান্না। পঞ্চব্যঞ্জনে শুরু হল ভুরিভোজ। সঙ্গী হল মেয়েও। সকলে মিলে বাপের বাড়িতে একটু স্পেশ্যাল আদর, মায়ের হাতের রান্না আর তালপাতার পাখার স্নেহমাখা হাওয়া, কার না ভাল লাগে ! জামাই ও খুশি খাতির পেয়ে, শাশুড়িও খুশি একটি দিন মেয়ে-জামাইকে কাছে পেয়ে!
এ দিকে দেশ জুড়ে চলছে লকডাউন । ফলে বহু কন্যা-জামাতাই এ বার আর আসতে পারবেন না মেয়ের বাপের বাড়িতে ।  যেমন পারেনি  আমার মেয়ে জামাই। তবু মেয়ে-জামাইয়ের জন্য দূর থেকে হোক বা কাছ থেকে, সমস্ত বাবা-মায়েরাই মঙ্গল কামনা করবেন, আশীর্বাদ করবেন প্রাণ ভরে। এই জামাই ষষ্ঠীর তাৎপর্য আসলে কী? এই অনুষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের মঙ্গল কামনা। আর 
মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতিতে শ্বশুরঘর আলো করা জামাই বাবাজি। পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত। আম-কাঁঠাল, ইলিশের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ ৷ আর তার আগে জামাইকে পাখা হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া! এমনকী, মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া! ‘জামাইষষ্ঠী’ বললেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৷ এতো তাই-ই ৷ তবে, মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্কটা কী এ প্রশ্ন উঠতে পারে ৷ মনের মাঝে উঁকি দিতে পারে এ সম্পর্কে শাস্ত্র কী বলছে?
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না ৷ এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল — সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে ৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে ৷ আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে ৷ বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে — কন্যার পিতামাতা অথবা যে ব্যক্তি কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি এক বৎসর কন্যার বাড়ি যাবেন না বা গেলেও কন্যার বাড়ির অন্নগ্রহণ করবেন না ৷ যদিও আধুনিক শহুরে জীবনে এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না ৷ সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে জামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেইসঙ্গে কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণ হল ‘জামাই ষষ্ঠী’৷
ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা ৷ তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম ৷ কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল ৷ ছোট বউ ছিল খুব লোভী ৷ বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে ’৷ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন ৷ তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল ৷ মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন ৷ যার জেরে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন ৷ এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন ৷ ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় ৷ অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে ৷
ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যান ও একাকী কাঁদতে থাকেন ৷ শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান ৷ সে তার দুঃখের কথা বলে ৷ তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় ৷ ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন | এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে ৷ তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় ৷ এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে ৷ এটাই জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতকথার মূল গল্প ৷ মামী আমাদের  ঘাটে বসিয়ে এই উপাখ্যান শোনাতেন।  আমরাও প্রতি বছর আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতাম এই গল্প শোনার। এখন সবই স্মৃৃতি। 
এদিকে যে সময় জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে, প্রকৃতিতে আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি নানা ফলের সমারোহ ৷ তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীর পূজা করেন ৷ তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে বসিয়ে প্রথমে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন ও দীর্ঘজীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক তেল-হলুদে চোবানো সুতো হাতের কবজিতে বেঁধে দেন ৷ এরপর আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন ৷ আর সামনে বিবিধ মিষ্টান্নসহ নানা ফল খেতে দেন ৷ অবশ্য জামাই বাবাজীও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় যেমন দই-মিষ্টি আনতে ভোলে না তেমনি আশীর্বাদের পর প্রণামী হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্রাদি দিয়ে থাকে ৷ আমি জামাই না এলেও জামাই তার দায়িত্ব অবহেলা করেনি।প্রণামী  শশুর শাশুড়ি দুজনের জন্যই পাঠিয়ে দিয়েছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *