ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লহ প্রণাম –
বঙ্গকেশরী তিনি, বাঙ্গালী হিন্দুর আগ্নেয় প্রতিস্পর্ধার শেষ প্রতিমূর্তি তিনি –
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয় তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে, “আজ শোকে মুহ্যমান হইয়া বাংলার দুর্ভাগ্য ও বাঙ্গালী সমাজের দুর্ভাগ্য সমস্ত মন দিয়া অনুভব করিয়াছি। সদ্য অতীত ইতিহাসের পটভূমিকায় যেন সেই দুর্ভাগ্যের চিত্ত অন্তর্দৃষ্টির সম্মুখে প্রকট করিয়া দিয়াছে। হায় অভিশপ্ত ভূমি! তোমার নেতৃস্থানীয় সন্তানদের জীবন কোনক্রমে পঞ্চাশের সীমা অতিক্রম করিতে চাহে না। জীবনের অভিজ্ঞতা ও কর্মের শিক্ষা লইয়া দেশ ও সমাজের হিতার্থে কাজ করিবার সময় যখন আসে, সেই পরিপূর্ণ কর্মপ্রয়াসের মধ্যেই সহসা কর্মচ্ছেদের আহ্বান আসিয়া পড়ে। আজ ডঃ শ্যামাপ্রসাদের জীবনে তো সেই পরিণতি ঘটিল। বাঙ্গালী সমাজের নেতৃস্থানীয় মধ্যে জীবনের পরিপূর্ণতার পূর্বেই এই যে প্রচন্ড মৃত্যুস্রোতের আঘাত, ইহা কিভাবে অবরুদ্ধ হইবে অথবা কোন কালে অবরুদ্ধ হইবে কি না তাহা বুঝিয়া পাইতেছি না।”
আদ্যন্ত শিক্ষাব্রতী তিনি; পিতা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাহচর্যে শিক্ষার অঙ্গনেই দিনযাপন করেছিল তাঁর তারুণ্য ও যৌবন, রাজনৈতিক প্রাঙ্গন ছিল তাঁর কাছে অজানা তবুও এইটিই হল তাঁর শেষ জীবনের আধার। রাজনীতি তাঁর কাছে ছিলো না অর্থাগমের কোন বিশেষ ক্ষেত্র, তাঁর প্রবেশ শুধুমাত্র নিজ জাতির রক্ষা ও অগ্রগতির স্বার্থে। ‘৩০র দশকের শেষার্ধে তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দু তথা বৃহত্তর হিন্দু জাতির উপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও মরুদেশীয় সাম্রাজ্যবাদের হীন ষড়যন্ত্রে হিন্দুর উপর যে অকথ্য নির্যাতন ঘটেছিল তার প্রতিকারে। ১৯৩৯ সালের খুলনায় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা সম্মেলনের সভাপতি রূপে নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য বাঙ্গালী হিন্দুকে বজ্রনির্ঘোষে যে আহ্বান দিলেন শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকর তা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মনোজগতে ঘটালো এক বিস্ফোরণ। জ্ঞানাঞ্জনের যে শলাকা তাঁর অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য চিত্তে প্রবেশ করল তাই রইল তাঁর সাথে আমৃত্যু।
অনমনীয় দৃঢ়তা, প্রতি মুহূর্তে আক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কাকে তুচ্ছ করে বাঙ্গালী হিন্দুর ভবিষ্যৎ রক্ষার লক্ষ্যে হয়ে চলে তাঁর অগ্রগতি, যখন হিন্দু-অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব এক অবাস্তব, অকল্পনীয় সত্য তখনও তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে নড়েননি এক মুহূর্তের জন্যেও। ক্রমশ যে ‘স্বয়মেব মৃগেন্দ্রিতা’ রূপে দেখা দিলেন তিনি, তাঁর সমর্থনে দেখা দেন রাজপথে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা, এমনকি তাঁর প্রভাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসও দিল্লির গান্ধী – নেহরু নেতৃত্বের diktat অস্বীকার করে অবতীর্ণ হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সৃষ্টির রক্তাক্ত পরিসরে, ‘৪৬র ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে যার প্রারম্ভ ভয়াল, ভয়ঙ্কর হিন্দু প্রত্যুত্তরের মধ্য দিয়ে, প্রবাসী লেখে সগর্বে, “আক্রমণকারী শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হইয়া গেল”, শেষ হয় ২০শে জুন, ১৯৪৭ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সৃষ্টি ও আগস্ট ১৫তে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে, বাঙ্গালী হিন্দুর উপর প্রত্যেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর প্রায় একক সংগ্রাম, সংসদের অভ্যন্তরে তাঁর সিংহ-সদৃশ বিচরণ; অত্যুত্তম বাগ্মিতা; পূর্ব পাকিস্তান, ১৯৫০-র হিন্দু গণহত্যা ও দুর্বলচিত্ত কেন্দ্রীয় সরকারের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তাঁর পদত্যাগ, লক্ষাধিক জনগণের হাওড়া স্টেশনে ছুটে যাওয়া এ-হেন অক্লান্ত মহারথীকে প্রত্যক্ষ করার জন্য, এ সবই চৰ্চিত বিষয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় – যাঁর মৃত্যুতে Amrita Bazar Patrika- র banner headline হয় ‘Home They Brought Her Warrior Dead’ তাঁর এহেন রহস্যজনক পরিণতির কারণ জানতে তাঁর একদা সহকর্মীরা, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের তথাকথিত ধ্বজাধারী রাজনৈতিক সংগঠন নির্লিপ্ত থাকে কেন? কেন তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হয় না তাঁর হত্যারহস্য উন্মোচন করতে? দুপক্ষের চিন্তা, হিন্দুত্বের সংজ্ঞা কি পৃথক?
প্রশ্ন এটিও – ১৯৭২ সালে খোসলা কমিশনে প্রতিজ্ঞা করে শ্রী দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু (নেতাজি সুভাষচন্দ্রের প্রিয়তম ও ঘনিষ্ঠতম ভ্রাতুষ্পুত্র) বলেন, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন যে রাঙাকাকাবাবু (নেতাজি) বেঁচে আছেন এবং এটি প্রকাশ করার জন্য তিনি এক উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হত্যারহস্যের মূল কারণটি কি? কাশ্মীর তাহলে কি নিছক একটি smokescreen?
শুধুই প্রশ্ন, আপাত এর উত্তর নেই।
উত্তর রয়েছে একমাত্র – মহাকালের কাছে।
বন্দেমাতরম।।