অযুত সামাজিক ও রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও পূজনীয়া দেবীর বিগ্রহের সম্মুখে সন্ধ্যারতি, সন্ধ্যাবন্দনা স্তব্ধ হয়নি কখনও – সহস্রাধিক বৎসরের সেই প্রায় ১২০ ফুট উচ্চ, রাজা রাজবল্লভের ঢাকা শহরের প্রাণস্বরূপা রমনা কালীবাড়ির চূড়া ধ্বংস করে পাকিস্তান আর্মি মার্চ ১২, ১৯৭১-এ, তৎসহ মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন শ্রী শ্রী আনন্দময়ীমা আশ্রমের সকল হিন্দু ভক্ত ও দর্শনার্থীদের নৃশংসতম গণহত্যার মধ্য দিয়ে – হিন্দুর জাতিগত নির্মূলীকরণের অন্তর্গত এক অধ্যায় রূপে। বাকি মন্দির ধ্বংসের কাজ সুনিপুণভাবে সম্পন্ন হল যাঁর দ্বারা তিনি – শেখ মুজিবর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ও জেহাদি নৃশংসতার বলি শ্রী পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের তপস্বিনী জটালি মায়ের মন্দির পুনর্নিমাণের কাতর প্রার্থনা অস্বীকার করা হয়নি শুধু: দুজন শোকার্ত, বিধ্বস্ত নারীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দেয় মুজিব। অনুমতি দেওয়া হয়েছিল শুধু ঢাকার নিকটস্থ পোস্তগোলার শ্মশান সংলগ্ন একটি চারণভূমিতে তাঁবুর মধ্যে থাকার ন্যূনতম সরকারী সাহায্য বিনা। ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় এসেই জিয়াউর রহমানের নির্দেশে পোস্তগোলার চারণভূমি থেকেও বেয়নেটের মুখে উচ্ছেদ করা হয় তাঁদেরকে। ২.২ একরের ব্রহ্মোত্তর জমি সরকারী যথেচ্ছাচারে পরিণত হয় পর্যদুস্ত বাঙ্গালী হিন্দুর পরাজয়ের চিহ্ন রূপে।…. ২০২১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় ও ৭ কোটি টাকার অনুদানে গঠিত হলো রমনা কালী মন্দির পুনরায় কিন্তু মূল জমিতে নয়, তার পার্শ্বে।
অত্যাচারের গাথা, ব্যথা ও চিহ্ন নিয়ে বারাণসীতে নবনির্ম্মিত কাশী মন্দির প্রাঙ্গণ ও ঢাকাতে রমনা কালী মন্দির প্রাঙ্গণে গঠিত হল। কিন্তু Compiègne Wagon-এর পুনরাবৃত্তি হল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, নভেম্বর ১১, ১৯১৮ সালে এই railway carriage – এই রচিত হয়েছিল ফ্রান্সের নেতৃত্বে armistice ও বিধ্বস্ত জার্মানির ধ্বংসাবলী। ২২শে জুন, ১৯৪০ সালে প্রতিশোধরূপে জার্মানি সেই একই railway carriage ব্যবহার করেছিল নয়া armistice ও পরাজিত ফ্রান্সের রচনায়। এই ইতিহাস গঠন করতে প্রয়োজন এক আগ্নেয় তপস্যা ও সামর্থ্যবান হয়ে ওঠার অনমনীয় প্রজ্ঞা, প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় – যা জার্মানরা অসামান্য ধীশক্তি ও অকল্পনীয় শ্রমে অর্জন করতে সমর্থ হলেও হিন্দুরা ব্যর্থ প্রতি পদেই আপাততঃ। জগৎমাঝে শক্তিই একমাত্র আধার, তা বিনা সকলই আঁধার।
এই নবনির্ম্মিত মন্দিরদ্বয় মধ্যযুগের সুউচ্চ ও অভূতপূর্ব সোমনাথ মন্দির ন্যায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুনরায় আক্রান্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে কিনা তা লেখা আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎও অন্য হতে পারে এবং তা নির্ভর করে হিন্দুর বিধ্বংসী প্রতিরোধশক্তির উপরেই। শাস্ত্র বিনা শাস্ত্র ও সংস্কার সুরক্ষিত হয় না। হিন্দু অনুভব করুক এই অমোঘ সত্য তাঁর সমগ্র সত্তা দিয়ে।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (শ্রীমদ্ভগবদগীতা)