তসলিমা যা লিখেছেন তার প্রায় সবই বাংলা ভাষাতে। রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি বাংলাতে লিখে সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। এর বিপরীতে অনেক ভারতীয় এবং কিছু বাঙালি লেখক ও গবেষকের নিজ মাতৃভাষা ছেড়ে সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষা ইংরেজিতে লিখে বিশ্বে নিজেদের পরিচিত করবার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষণীয়। দুই/একজন ব্যতিক্রম বাদে তাদের কেউই বিশ্ব বা নিজ জনগোষ্ঠী কারো কাছেই পরিচিতি বা গ্রহণযোগ্যতা পাননি।
বর্তমানে নির্বাসিত জীবনেও দু’হাতে লিখে যাচ্ছেন তসলিমা। তার কলাম নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের দুইটি সংবাদপত্রে। ফেসবুকেও তিনি অত্যন্ত সক্রিয়। কিন্তু তার লেখার আবেদন বা সমাজে এর প্রতিক্রিয়া যেন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এর মূল কারণ হল তসলিমা দেশান্তরী হবার পরে নতুন আরেকটা প্রজন্ম দাঁড়িয়েছে যাদেরকে বলা যায় ‘তসলিমা প্রজন্ম’। এদের মনোজগতে তসলিমার চিন্তাধারা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তসলিমা যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটাই তারা বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েব পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আরো তীব্রভাবে বলা শুরু করেছে। এর ফলে জনগণের মাঝে একটা আপেক্ষিক সহিষ্ণুতা বা অভ্যস্ততার সংস্কৃতির জন্ম নিয়েছে যা ব্যক্তি হিসাবে তসলিমাকে ম্রিয়মান করে ফেলছে।
তসলিমার সার্থকতা এ জায়গাটিতে যে, যত ক্ষুদ্রই হোক তিনি তার চিন্তাধারার আলোকে একটা প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছেন, যেটা বাংলাদেশের আর কোনও চিন্তাবিদ সে অর্থে পারেন নাই; এমনকি আহমেদ ছফাও এ ক্ষেত্রে তেমন সফল হন নাই। ফরহাদ মজহারও স্বাধীন চিন্তাধারার জন্ম দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণপন্থার রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
তসলিমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল নিজের চিন্তাধারার সাথে কোনও অবস্থাতেই আপস না করা-সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন। সেই আপস না করতে পেরে তিনি যেমন দেশছাড়া হয়েছেন, তেমনি অনেক পরিচিত মানুষ থেকেও নিজেকে বিছিন্ন করে ফেলেছেন, চিন্তাধারা বা ব্যক্তিজীবনে বনিবনা না হবার কারণে। কিন্তু, তিনি অটল থেকেছেন যেটাকে তিনি সঠিক মনে করেছেন সে বিষয়ে।
নিজে দেশছাড়া হলেও মানসিকভাবে তসলিমা পড়ে থাকেন বাংলাদেশে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ প্রচলিত যেকোনও আইনে যেকোনও সাজা মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরতে ইচ্ছুক। নাগরিকত্ববিহীন অবস্থায় গোলাম আজম অথবা হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা আব্দুল লতিফ সিদ্দীকিকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করলেও তসলিমাকে না ফিরিয়ে আনবার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এ দু’টি দলই একমত। যদিও রাজনীতির আর প্রায় কোনও বিষয়ই তাদের মাঝে ঐক্যমত্য দেখা যায় না।
কোনও শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ যখন জেলে বা নির্বাসনে যান তখন তার পিছনে থাকে কোটি জনতার সমর্থন। বিপুল জনতার সমর্থন যে কাউকে যেকোনও অবস্থাতেই মানসিকভাবে করে তোলে শক্তিশালী।
তসলিমা নির্বাসিত জীবন যাপন করেন প্রায় একা। তবুও তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার ইতিহাসে অন্যতম সাহসী ব্যক্তিত্ব।