অন্বেষণ শব্দটির অর্থ অনুসন্ধান, গবেষণা। তাঁর সমগ্র জীবনই ছিল এক অন্বেষণ, পরমারাধ্য সত্যের। যে সত্য মানুষের অন্তরকে উদ্ভাসিত করে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে নিজ ও তাঁর স্বীয় পরিবারের ঊর্ধে উঠে জাতির সেবায়। তাঁর আবির্ভাব এমনই এক যুগে যখন একই অন্বেষণের বার্তা ও সমাজজীবনে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল ক্রমশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাবে নবজাগরণের দেদীপ্যমান সূর্যের আলোক প্রভাবিত করেছিল এক প্রজন্মকে,যার অগ্নিশিখা অভিভূত করেছিল পরের প্রজন্মকে এবং তার ফল্গুধারা এখনো বহমান, যতই ক্ষীণ হোক না কেন।
এই ধারার প্রবর্তক অবশ্যই তিনি – ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসীরূপেই তাঁর পরিচয় বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষ তথা বহির্ভারতে। ধর্মের গূঢ়ার্থ যে সমাজজীবন বিচ্ছিন্ন নয় তা ঘোষিত হয়েছিল তাঁর বজ্রকণ্ঠে। তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দেশপ্রেমের নব সংজ্ঞা যার সার্থক প্রকাশ ঘটে অখণ্ড বঙ্গের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনিই ছিলেন তাঁর প্রেরণপুরুষ। ১৯০১ সালে ঢাকা শহরে অবস্থানকালে তাঁর সাক্ষ্যাৎপ্রার্থী হন একদল যুবক যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিপ্লবী মুক্তিসংঘ গোষ্ঠীর প্রণেতা শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ মহাশয় (অষ্টাদশবর্ষীয় তরুণ মাত্র তখন)…..সাক্ষ্যাৎ শেষে ধর্মপথে ব্রতী হওয়ার আশীর্বাদ চাইলে সেই সন্ন্যাসী সজোরে বলে ওঠেন যে জাতি, দেশ পরাজিত, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ তার ধর্ম একমাত্র দেশমাতৃকার শৃঙ্খলামোচন। এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে, এই বক্তব্যই সূত্রপাত হল এক অনমনীয় বিপ্লবী সংগ্রামের। যে ধারার অনুসারীরা এক মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং যার আহ্বান এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
তিনিই স্বামী বিবেকানন্দ। মরণভয়কে যে তুচ্ছ করে দেশের স্বার্থে আত্মনিবেদন করা যায়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে এক অসামান্য প্রভাব বিস্তার করা যায় তা তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে কখনও বোধগম্য হয়নি। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন তাঁর পূর্ববর্তী যুগের মহামানব সন্ন্যাসীদের বাণী, ভারতবর্ষও যা পুনরায় স্মরণ করেছিল তাঁর মাধ্যমেই। প্রশ্ন ওঠে – আজ কি আমরা তা বিস্মৃত হয়েছি না সেই আগ্নেয় চিন্তা প্রবাহকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করার লিপ্সা নিয়েই এগিয়ে চলেছি? কিছুকাল আগে যাঁরা তাঁর বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা খুঁজে পেতেন এবং তাঁকে শ্রেষ্ঠ রূপে গ্রহণ করতেই অপারগ ছিলেন তাঁদের আজ দেখা যায় স্বামীজীর বক্তব্যের অংশবিশেষ ব্যবহার করে নিজ স্বার্থপূরণ করতে। তা কি এই প্রজন্ম মেনে নেবে না এই ধর্মবিদ্বেষী ছলনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে?
প্রশ্ন বহু। তার উত্তর খুঁজে, সকল ষড়যন্ত্র পরাস্ত করে এক নতুন গতি নির্মাণের দায়িত্ব আমাদেরই। লক্ষ্য কি? যা আমার জাতিহিতার্থে তাই আমারর ব্যক্তিজীবনের ধ্রুবতারা। নইলে গতি হারাবে হিন্দু, নির্যাতিত হিন্দু জাতি পথ হারাবে নিশ্চেষ্টতার এক পঙ্কিল আবর্তে।
স্বামী বিবেকানন্দকে ও তাঁর আদর্শকে কেবলমাত্র পুস্তক ও চিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে ছদ্ম-ধর্মনিরপক্ষেতার সর্বনাশ যা করাঘাত করছে জাতির সদর দরজায় তা স্থায়ী হবে মননে ও সমাজের অভ্যন্তরে। Masculine Hinduism – এর চিন্তা যা স্বামী বিবেকানন্দের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ তা প্রতিষ্ঠিত হোক হিন্দুজাতির মধ্যে। তাঁর অমর বাণী – শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ।
নমঃ শ্রীজতিরাজায় বিবেকানন্দ সূরয়ে I
সচ্চিত সুখস্বরূপায় স্বামিনে তাপহারিনে II
প্রণাম করি স্বামী বিবেকানন্দকে আজ তাঁর আবির্ভাবের পুণ্যতিথিতে।
লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী