তিনি সুভাষচন্দ্র বসু – বহির্বিশ্বে পরিচিত নেতাজি

অনিমিত্র চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ ভারত

তিনি সুভাষচন্দ্র বসু – বহির্বিশ্বে পরিচিত নেতাজি রূপে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে নিঃস্ব, অধঃপতিত, বিধ্বস্ত বাঙ্গালী হিন্দুর বড় আপনার ধন। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলা বাতুলতাই বটে – কিন্তু আবেগের বহিঃপ্রকাশেরও প্রয়োজন থাকে।

বিপ্লবী-সাধক শ্রী পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে, সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের পঞ্চ মহাক্ষত্রিয়ের অন্যতম তিনি – অপর চার জন শ্রী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্রী রাসবিহারী বসু, অধ্যাপক শ্রী জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ ও শ্রী হেমচন্দ্র ঘোষ।

তিনি অদ্বিতীয়, একমেবাদ্বিতীয়ম, মূর্ত প্রতীক প্রতিস্পর্ধা ও ক্ষাত্রশক্তির, বৈপ্লবিক তারুণ্য ও বিধ্বংসের, শ্রেষ্ঠত্বের ও নব নির্মাণের, প্রজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞার, অনুশাসন ও পরাক্রমের। অখণ্ড বঙ্গের যবন-বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যক্তিগত সন্ত্রাস সৃষ্টির প্রাথমিক স্তর থেকে সংগঠিত সেনাবাহিনীর প্রকাশ ঘটেছিল তাঁরই নেতৃত্বে এবং অবশ্যই তা নবরূপে প্রকাশ করেছিল স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা প্রদত্ত উদাত্ত আহ্বানের – লৌহদৃঢ় মাংসপেশী, ইস্পাত-কঠিন স্নায়ু ও বজ্রভীষণ মনোবলের। অনুশীলন-যুগান্তর বিপ্লবী গোষ্ঠীদ্বয়ের মধ্যকার প্রচন্ড বিরোধের সময়ে তাঁর দৌত্য চিরস্মরণীয়। একইসাথে এটিও ঠিক ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের সময়ে হিন্দু স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক তথা কথাশিল্পী শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যার অন্যতম, তা সুভাষচন্দ্র মেনে নিলেও ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের সাথে ফরওয়ার্ড ব্লকের নির্বাচনী আঁতাতে কলকাতা কর্পোরেশনে লীগের প্রবেশকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের সমালোচনা তাঁর বিরুদ্ধে হয়েছিল – ছুভাছ মিঁয়া ও আচার্য ইস্পাহানি নাম করে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি মুখর হলেও তাঁর বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিল নতমস্তকে।

প্রশ্ন ওঠে – নেতাজি সুভাষচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব, মৌলিকত্ব কিসে? অবশ্যই সামরিকবাদ বা militarism এ। যদিও এ সম্পর্কিত চিন্তা সর্বপ্রথম প্রকাশ পায় ১৮৬৭-৭০
এর হিন্দু মেলায়, শ্রী প্রমথনাথ মিত্র ও শ্রী পুলিনবিহারী দাসের অনুশীলন সমিতির সাংগঠনিক গঠনপ্রণালীতে, ঋষি অরবিন্দের বিখ্যাত উত্তরপাড়া বক্তৃতায়, ভারতীয় বিপ্লবের ব্রহ্মারূপে পরিচিত শ্রী যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/নিরালম্ব স্বামীর চিন্তা ও কার্যে, তার চূড়ান্ত সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে রাসবিহারী বসু ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র দ্বারা গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে। একথা অনস্বীকার্য, জাতিস্বার্থে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও অনুশাসনের প্রয়োজনীয়তার অনুভব তৎকালীন যুগে সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু ও বীর  সাভারকার ব্যাতিরেকে আর কোন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়না। মুসোলিনির প্রতি তাঁর অনুরক্তি সুবিদিত, হিন্দু মহাসভার ড: বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জের মতো তিনিও ফ্যাশিস্ট ইতালির Balilla ও Avanguardisti পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

Strong party, strict discipline and stringent ruleই ছিল তাঁর মন্ত্র যদিও বহু ক্ষেত্রে তিনি dictatorship শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে ভারতবর্ষে এই চিন্তাধারার প্রয়োগই হয়নি বরং তারাই জাঁকিয়ে বসলো যারা দৌড়ে সামিলই ছিলোনা।

প্রায় ৮০ বছর ধরে তিনি অনুপস্থিত জাতীয় জীবনে, বিশেষত বাঙ্গালীদের মধ্যে, কিন্তু প্রভাব অসামান্য। তিনি একাকী কিন্তু পান্ডিত্য ও বৈভব তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে নতঃশিরে। প্রতি বছর ২৩শে জানুয়ারির আগে তাঁর মূর্তি, ছবি পরিস্কার করা হয়, তাতে মালা পড়ে, অর্বাচীনেরা তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনা মুখস্থ করে বাৎসরিক দায় পালনে সচেষ্ট থাকে কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত চেতনার স্ফুরণ ঘটেনা। তা ঘটবে একমাত্র যখন বাঙ্গালী মেরুদণ্ড টান করে তাঁর এই ছবির সামনে দলবদ্ধভাবে march করবে – ১৯২৮ সালে তাঁরই নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বৈপ্লবিক গোষ্ঠীর মতো – চরৈবেতি, চরৈবেতি।

ধ্যানমূলং গুরুর্মূর্তি পূজামূলং গুরুর্পদম,
মন্ত্রমূলং গুরুর্বাক্যং মোক্ষমূলং গুরুকৃপা।।

লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *