তুলে ধরলাম ম্যারাডোনার স্মৃতিকে

Uncategorized

(দিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা ও লিওনেল মেসি’কে নিয়ে দীর্ঘ লেখা লিখছিলাম গত দুই বছর ধরে।
আজ জানলাম ম্যারাডোনা নেই।
জানতাম খ্যাতির শিখরে পৌঁছে অযত্ন ও অবহেলায় গড়া শরীরের ধকল নিতে পারছিলেন না ফুটবল ঈশ্বর। কিন্তু এতো জলদি চলে যাবেন ভাবিনি।
ল্যাটিন ফুটবল নিয়ে আমার লেখা ‘আমার আর্জেন্টাইন আবেগী বিবাগী মন’ থেকে কিয়দংশ তুলে ধরলাম ম্যারাডোনার স্মৃতিকে উৎসর্গ করে।)

ওহ দিয়াগো!!

প্যারাগুয়ে সীমান্তে আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কোরিয়েন্তেস নদীর অববাহিকায় ইণ্ডিয়ান আদিবাসী ‘গুয়ারিনি’ গোত্র সেই স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক আমলের সময় থেকে বাস করে আসছে। কলোনিয়াল যুগের আধুনিক সমৃদ্ধি তাদের জীবন যাত্রার মানে খুব একটা হেরফের ঘটায় নি। সুঠাম স্বাস্থ্যের সুবাদের ভারী জিনিষপত্র বয়ে নেয়া মানে কুলিগিরি ছাড়াও অন্যান্য শারিরীক পরিশ্রমের কাজের জন্য তাদের ডাক পড়তো। 
সেই গোত্রে জন্ম নেন চিতোরো, ম্যারাডোনার বাবা। জীবনের শুরুতে কোরিয়েন্তেস নদীর পাড়ে নিজ গোত্রের মাঝে গৎবাঁধা জীবন কাটালেও ইউরোপিয়ানদের আমদানী করা ফুটবল ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। তুলার বস্তা কাঁধে নিতে গিয়ে একবার বুকের পাঁজরের তিনটা হাঁড় ভেঙ্গে গেল বেকার হয়ে পড়েন চিতোরো। হাতে কাজ না পেলে বেরিয়ে পড়তেন পূর্ব পুরুষদের মতো কাঠের ক্যানু ভাসিয়ে মাছ ধরতে, অথবা বনে-জঙ্গলে হরিণ, আর্মান্ডিলা, সাপ শিকার ছিল জীবন ধারণের অন্যতম ভরসা।
প্রতি রোববার ছুটির দিনে ছোটভাই চিরিলো’কে সাথে নিয়ে ভরপুর মদ খেয়ে দাপিয়ে ফুটবল খেলতেন। তবে ফুটবলার হিসেবে সুনাম বেশী কুড়িয়েছিলেন চিরিলো। ১৯৫২ সালে স্থানীয় স্যান মার্টিন ফুটবল দলের হয়ে ঘরোয়া লীগে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন চিরিলো।   

ম্যারাডোনার নানী সালভাদোরা করিয়োলচি ছিলেন দক্ষিণ ইতালী থেকে আসা অভিবাসী দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
মাত্র সতের বছর বয়সে জন্ম দেন ‘অবৈধ’ কন্যা সন্তান। নাম রাখলেন ডোনা তোতা।
তোতা তাঁর জন্মদাতা পিতা অ্যাতানানসিয়ো ফ্রাংকো’র স্বীকৃতি পান যখন বয়স আঠার বছর। একুশ বছর বয়সে তোতা চলে এলেন রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে নতুন জীবনের সন্ধানে। কাজ নেন ধনীদের বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে। এরপর চিতোরোকে নিয়ে আসেন বাড়তি আয়ের আশায়।
তোতা’র আগ্রহে নদী অববাহিকার বুনো জীবন ছেড়ে হঠাৎ করে বুয়েন্স আয়ার্সের ইট পাথরের জঙ্গলে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিলো চিতোরো’র। কিছুদিন কুলিগিরি করে পরে কাজ নেন বাসস্থান ভিলা ফিয়োরতিও’র কাছে এক গরুর হাঁড় গুড়ো করার কারখানায়। আর্জেন্টিনা সেই সময় গরুর মাংস রপ্তানীতে শীর্ষে ছিল। গরু ও অন্যান্য সব ধরনের পশুর হাঁড় ছাড়াও সেই ফ্যাক্টরীতে বেওয়ারিশ মানুষের হাঁড় পর্যন্ত কাটা ও গুড়া করা হতো বলে অভিযোগ আছে।
দমবন্ধ করা পুঁতিগন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হতো চিতোরোদের মতো শ্রমিকের দৈনিক বার ঘন্টা। পরবর্তীতে পুত্র ম্যারাডোনা বিখ্যাত না হলে হয়তো অন্যন্য শ্রমিকের মতো চিতোরো অনেক আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন, ফুসফুস ক্যান্সার বা দূষণজনিত অন্য কোন রোগে ভুগে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্জেন্টিনার হাল ধরেন জেনারেল হুয়ান পেরন। মুসোলিনি ও হিটলারের ভক্ত তিনি। রক্ষিতা হতে দ্বিতীয় স্ত্রী’র মর্যাদা পাওয়া এভিটা পেরন ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহচর। এভিটা নিজেও এসেছেন দরিদ্র অবহেলিত পরিবেশ থেকে। সেই সূত্রে সবাই স্বপ্ন দেখতো তারাও একদিন এভিটার মতো আর্জেন্টিনার সম্রাজ্ঞী হবেন।
তোতা নিজেও এই জাতীয় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। পেরন-এভিটা জুটি জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদের দোহাই তুলে গরীবদের চোখে ঠুলি পড়িয়ে জনগনের হাতে তুলে দিলেন নতুন আফিম – ‘ফুটবল’। নব্য জাতীয়াতাবাদের মন্ত্রে নতুন আবেগের অস্ত্র হিসেবে ফুটবলকে নতুন করে বেছে নিলো আর্জেন্টিনার জনগণ। ফুটবলেই যেন দেশের যাবতীয় সমস্যার একমাত্র মুক্তি। কমবেশী একই অবস্থা তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্যান্য ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে।

তৃতীয় জন্মদিনে ম্যারাডোনা ছোট চাচা চিরিলোর কাছ থেকে জীবনের প্রথম উপহার হিসেবে পেলেন চামড়ার ফুটবল। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা ওটাই ছিল ডিয়াগো’র একমাত্র সঙ্গী।  চিতোরো তখন কাজ করেন স্থানীয় ফল বিক্রেতার কুলি হিসেবে। কিন্তু ছোট্ট ডিয়াগো’কে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন আকাশকুসুম। পুরো বস্তি চত্বরে শিশু ম্যারাডোনা খলখলিয়ে সেই ফুটবল পায়ে দৌড়ে বেড়ান। তোতা প্রশ্রয় দেন। লেখাপড়া করার দরকার নেই। প্রেসিডেন্ট পেরনের আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলে নাম করতে পারলে সব দুঃখ ঘুচে যাবে।
বালক বয়সে ম্যারাডোনা তাঁর বাবা-মা’র স্বপ্নকে আরো উস্কে দিতে অনেক বিশাল শপথ করেছিলেন। বলেছিলেন বড় হয়ে তিনি প্রিয় দল বোকা জুনিয়রস টিমে যোগ দেয়া ছাড়াও আরেকটি স্বপ্ন দেখেন। তা হলো আর্জেন্টিনার জন্য বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে আনা। অনেকে এটাকে বস্তির ছেলের মামুলি স্বপ্ন হিসেবে কথার কথা ধরে নিলেও ডোনা তোতা যেন জানতেন তাঁর ছেলে ঠিক পারবে।
ব্রাজিলের নান্দনিক কিংবদন্তী রোনালদিনহো তাঁর আইডল ম্যারাডোনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জানান, আমি বল নিয়ে যত কিছুই করি না কেন ম্যারাডোনার মতো কমলা লেবু পায়ে নিয়ে কিপি-আপি করে দেখাতে পারবো না।

স্প্যানিশ ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র দুইজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষ মাদ্রিদের বিপক্ষে গোল করেও বিপুল ভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে এই দুর্লভ সম্মান পাওয়া একজন হচ্ছেন বার্সেলোনার হয়ে খেলা রোনালদিনহো আর অন্যজন ডিয়াগো ম্যারাডোনা।
খেলোয়াড় হিসেবে এই অনুভূতি ফুটবল ক্যারিয়ারে সেরা স্বীকৃতির মধ্যে অন্যতম তা দুজনেই স্বীকার করেছেন।
তবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে ম্যারাডোনার মতো এতো স্পষ্ট ও ঠোঁটকাটা কোন ফুটবলার সম্ভবত আর নেই।

ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন,
‘মা বলেছেন আমি পেলের চেয়ে ভালো ফুটবলার। আমি নিজেও তা বিশ্বাস করি। কারন আমার মা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না।

(C) Miraj Ul Islam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *