দেবতার কার্যে,বিবাহে; অশৌচবিধি প্রযোজ্য নয়

Blog Uncategorized
দেবতার কার্যে,বিবাহে;
 অশৌচবিধি প্রযোজ্য নয়
বেদবিহিত জীবনধারাকে অনুসরণ করে বিভিন্ন ঋষি-মুনি এবং দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন মহাজন ধর্মাধর্মের পবিত্র নির্দেশনা দিয়েছেন, তাকেই স্মৃতিশাস্ত্র বলে। অপৌরুষেয় শ্রুতির সাথে সাথে স্মৃতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শ্রুতি ও স্মৃতি উভয়  হতেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত।
শ্রুতিস্ত্ত বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্ম্মাশাস্ত্রস্ত্ত বৈ স্মৃতিঃ।        
 ত সর্ব্বার্থেষ্বমীমাংস্যে তাভ্যাং ধর্মো হি নির্বভৌ।।
  ( মনুসংহিতা:২.১০)
“বেদের নাম শ্রুতি,ধর্মশাস্ত্রের নাম স্মৃতি। সকল বিষয়েই এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত ; কারণ  শ্রুতি ও স্মৃতি উভয় হতেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে।”
 বর্তমানে প্রায় অর্ধশতাধিক স্মৃতিশাস্ত্র প্রচলিত রয়েছে। এদের মধ্যে মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা, পরাশরসংহিতা, অত্রিসংহিতা, বিষ্ণুসংহিতা, হারীতসংহিতা, ঊশনঃসংহিতা, অঙ্গিরসংহিতা, যমসংহিতা, আপস্তম্বসংহিতা, সংবর্তসংহিতা, কাত্যায়নসংহিতা, বৃহস্পতিসংহিতা, ব্যাসসংহিতা, শঙ্খসংহিতা, লিখিতসংহিতা, দক্ষসংহিতা, গৌতমসংহিতা, শাতাতপসংহিতা, বশিষ্ঠসংহিতা এবং অধুনা সিন্ধুতটে লিখিত দেবলসংহিতা ইত্যাদি প্রমুখ। এদের মধ্যে মহত্বে, গুরুত্বে এবং ব্যবহারত্বে মনুসংহিতা এবং যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা অন্যতম। 
সনাতন ধর্ম সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার করে  অবিচ্ছিন্ন ধারায় বর্তমানকাল পর্যন্ত বহমান। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের জীবনধারা অনেক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। নগরায়ণ এবং শিল্পায়নকে কেন্দ্র করে মানবজীবন এক অনন্য  আধুনিক সভ্যতায় প্রবেশ করে দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবনের বিভিন্ন বিধিবিধান আর পূর্বের মত নেই। এ পরিবর্তিত জীবনধারার কারণেই আমাদের স্মৃতির অনেক বিধিনিষেধ বর্তমান যুগে জন্য কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনহীন হয়ে গিয়েছে।তাই আমাদের স্মৃতির বিধানগুলোকে বর্তমান কালের জন্য উপযোগী করে নেয়া প্রয়োজন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তীকে ঠিক এ নির্দেশনাই প্রদান করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি বলেছেন মহর্ষি মনু, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের বিধানে আজও চলতে হবে। তবে যুগের প্রয়োজনে সে  বিধান কিছুটা কালপ্রবাহের ধুলা ঝেড়ে সময়োপযোগী পরিবর্তন করে নিতে হবে।
” শিষ্য। তবে মহাশয়, এখন আমাদের কি করিতে হইবে?
স্বামীজী। ঋষিগণের মত চালাতে হবে; মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের মন্ত্রে দেশটাকে দীক্ষিত করতে হবে। তবে সময়োপযোগী কিছু কিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে।”
(স্বামী বিবেকানন্দ বানী ও রচনা, ‘স্বামী-শিষ্য -সংবাদ’, নবম খণ্ড, কলকাতা: ২০১৫, পৃ.৯৭)
বৈদিক সংস্কারবিধিতে বিবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কার। আমাদের প্রচলিত শাস্ত্রের বিধানে মহাগুরুদের মৃত্যুতে একবছর বিবাহাদি এবং যজ্ঞ সহ সকল আধ্যাত্মিক কৃত্যানুষ্ঠান পরিত্যক্ত হয়। মহাগুরু হলেন জন্মদায়িনী মাতা এবং জন্মদাতা পিতা। এমনও দেখা যায় যে বিবাহের সম্পূর্ণভাবে আয়োজন আয়োজিত করার মধ্যভাগেই বর-কনের পিতামাতা অথবা পিতামাতার পিতামাতা মধ্যে কোন একজন আকস্মিক মৃত্যু বরণ করে। ফলশ্রুতিতে বিবাহের সকল আয়োজনই স্থগিত হয়ে যায়,পণ্ড হয়ে যায়। পরবর্তীতে একটি বছর অতিবাহিত করে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। অথচ স্মৃতিশাস্ত্রের অধিকাংশ স্থানেই বিবাহ, যজ্ঞদেববিগ্রহাদি প্রতিষ্ঠা সহ বিবিধ আধ্যাত্মিক ক্রিয়া, দানকর্মে, যুদ্ধকালীন অরাজক পরিস্থিতিতে, দেশবিপ্লবে অশৌচবিধিকে রহিত করা হয়েছে।সে সময়ে সদ্যঃশৌচ উক্ত হয়েছে। অর্থাৎ অশৌচগ্রস্ত ব্যক্তি স্নানমাত্রই শুদ্ধ হয়ে নিজের আবব্ধ কাজ করতে পারবে।বিবাহের দিন বা বিবাহের সময়ে যদি নিজের স্বজন বা সপিণ্ড জননাশৌচ বা মরণাশৌচ হলেও, স্মৃতির বিধানে বিবাহ হতে পারবে। এতে শাস্ত্রীয় কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। বর্তমানে অনেক সময়ে আকস্মিক অশৌচ ঘটনায় অশৌচ পালন করতে গিয়ে আরব্ধ বিবাহ বন্ধ করে দিতে হয়। বিষয়টি বরকনের পরিবার সহ উপরে ব্যাপক বিস্তার করে। অনেক সময়ে দেখা যায় পরবর্তীতে সেই স্থগিত করা বিবাহ আর হয় না; ভেঙে যায়।অথচ আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রে বহুপূর্বেই এ সকল পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া আছে। আমরা অনেকেই সেই আপদকালীন সময়ে করণীয় প্রসঙ্গে আজও সন্দিগ্ধ। এ প্রসঙ্গে বিষ্ণুসংহিতায় ভগবান শ্রীবিষ্ণু বলেছেন:
” ন দেবপ্রতিষ্ঠাবিবাহয়োঃ পূর্বসম্ভূতয়োঃ।।
ন দেশবিপ্লবে।।
আপদ্যপি চ কষ্টায়াম্।।
( বিষ্ণুসংহিতা:২২.৫২-৫৪)
“দেববিগ্রহাদি প্রতিষ্ঠা এবং বিবাহাদি সকল সংস্কারকার্য আরব্ধ বা একবার শুরু হলে আর সেই কাজে অশৌচ প্রতিবন্ধক হয়না।দেশবিপ্লবেও অশৌচ থাকে না। কষ্টকর আপদকালীন অশৌচ থাকে না।”
ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশনাই পুনরাবৃত্তি হয়েছে দক্ষসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা, উশনঃসংহিতা সহ বিবিধ স্মৃতিশাস্ত্রে। দক্ষ সংহিতায় প্রজাপতি দক্ষ আরও একধাপ এগিয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, সকল প্রকারের অশৌচবিধি শুধুই সুস্থ ব্যক্তি এবং স্বাভাবিক সময়ের জন্যে। অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক সময়ের জন্যে নয়। যিনি বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি তার জন্যে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে বেঁচে থাকাই হল ধর্ম। তাই তার জন্যে কোন অশৌচবিধি নেই।”
“যজ্ঞকালে বিবাহে চ দেশভঙ্গে তথৈব চ।
হূয়মানে তথাগ্নৌ চ নাশৌচং মৃতসূতকে।।
সুস্থকালে ত্বিদং সর্বমশৌচং পরিকীর্তিতম্।
আপদগতস্য সর্বস্য সূতকে ন তু সুতকম্।।
( দক্ষ সংহিতা:৬.১৮)
“যজ্ঞকালে, আরব্ধ বিবাহে, দেশবিপ্লবে এবং হোমারম্ভ করলে জনন-মরণে অশৌচ হবে না।এ সকল অশৌচ সুস্থ ব্যক্তির জন্যে করণীয়; যিনি আপদগত ব্যক্তি তার কোন অশৌচবিধি নেই।”
বৈদিক ঋষি ব্রহ্মজ্ঞ যাজ্ঞবল্ক্যও ভগবান বিষ্ণুর কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। পূর্বসঙ্কল্পিত দ্রব্যদানে,
যজ্ঞকরার জন্যে যজ্ঞ প্রক্রিয়া শুরু হলে, বিবাহের আয়োজন শুরু হলে, যুদ্ধকালীন সময়ে, দেশবিপ্লব সহ সকল বিপদকালীন সময়ে সপিণ্ডজনের অশৌচ হবেনা। পক্ষান্তরে আরব্ধ শুভ এবং পবিত্রকার্যগুলো যথারীতি সম্পন্ন হবে।
দানে বিবাহে যজ্ঞে চ সংগ্রামে দেশবিপ্লবে।
আপদ্যপি চ কষ্টায়াং সদ্যঃ শৌচং বিধীয়তে।।(যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা: ৩.২৯)

“পূর্বসঙ্কল্পিত দ্রব্যদানে, আভ্যুদয়িক বিবাহাদি সংস্কারকার্যে, সঙ্কল্পিত যজ্ঞে, যুদ্ধ, দেশবিপ্লব সহ  অতি কষ্টকর বিপদকালে সদ্যঃশৌচ বিহিত।”
বিখ্যাত স্মৃতি শাস্ত্রকার ভৃগুবংশীয় মহর্ষি উশনের সিদ্ধান্তও একই। তিনি বলেছেন- যজ্ঞ, বিবাহ, দেবকার্যকালে অশৌচ হবেনা। শুধু স্নানমাত্রই শুদ্ধ হবে।
যজ্ঞে বিবাহকালে চ দেবযোগে তথৈব চ।
সদ্যঃশৌচং সমাখ্যাতং দুর্ভিক্ষে বাপ্যুপদ্রবে।।(উশনঃসংহিতা:৬.৫৮)
“যজ্ঞে, বিবাহকালে, আরব্ধ সংস্কারকার্যে, আরব্ধ দেবপ্রতিষ্ঠাদিকার্যে, দুর্ভিক্ষকালে এবং রাজশক্তির উপদ্রবকালে শান্তিস্বস্ত্যয়নাদিকার্যে সদ্যঃশৌচ উক্ত হয়েছে।”
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *