জননী এবং জন্মভূমি সকলেরই শ্রদ্ধার বস্তু। জননীকে যেমন ভালবাসতে হয়, জন্মভূমিকেও তেমনি ভালবাসতে হয়। কথায় বলে, জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। জননীর সেবা শুশ্রুষা সন্তানের কর্তব্য। জন্মভূমির কল্যাণ সাধনও। দেশবাসীর পবিত্র দায়িত্ব। দেশের উন্নতির জন্য যারা কাজ করে, দেশকে যারা ভালবাসে, তারা দেশপ্রেমিক। নারী পুরুষ সবাই দেশের সেবা করতে পারে। মহাভারতের যুগেও দেখা যায় এক নারী দেশের সেবায় আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। তাঁর নাম জনা।
জনার স্বামীর নাম নীলধ্বজ। মাহিস্মতী দেশের রাজা ছিলেন তিনি। জনার ছেলের নাম প্রবীর। একবার পাণ্ডব যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। তিনি যজ্ঞের অশ্ব ছেড়ে দিলেন। যজ্ঞের অশ্ব যে সব দেশ। না বাধায় ঘুরে আসবে সে সব দেশ যজ্ঞকারী রাজার অধীন হবে। তবে অশ্বকে কেউ আটক করলে তার সঙ্গে যজ্ঞকারীর যুদ্ধ হবে। এটা ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞের নিয়ম।

পাণ্ডবদের যজ্ঞের অশ্ব বিভিন্ন দেশ অতিক্রম করছে। অনেক দেশ ঘুরে সেই অশ্ব এসেছে মাহিস্মতী রাজ্যে। এই রাজ্যের রাজপুত্র প্রবীর অশ্বটিকে আটক করল। এতে পান্ডবদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বেধে গেল।
রাজা নীলধ্বজ ছেলে প্রবীরকে যজ্ঞের অশ্ব ছেড়ে দিতে বললেন। কারণ পাণ্ডবরা খুবই শক্তিশালী। তাই তিনি পান্ডবদের বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুতি। কিন্তু এ প্রস্তাবে বাধা দিলেন দেশপ্রেমিকা রানী জনা। তিনি দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বামী ও পুত্রকে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ না করে পরাজয় স্বীকার করা অধর্ম। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা। করা অবশ্য কর্তব্য।
রানী জনার কথায় রাজা নীলধ্বজ ও রাজপুত্র প্রবীর উৎসাহিত হলেন। পান্ডব সৈন্যদের সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধ আরম্ভ হল। প্রবীরের বীরত্বে পান্ডবদের বহু সৈন্য মারা পড়ে। পান্ডবদের সেনাপতি ছিলেন বিখ্যাত বীর অর্জুন। তিনি প্রবীরের বীরত্বে মুগ্ধ হন। কিন্তু এক সময়ে অর্জুনের প্রচন্ড আক্রমণে প্রবীর মৃত্যু বরণ করেন।
প্রবীরের মৃত্যু সংবাদে তাঁর মা জনা ব্যথিত হন, দুঃখ পান। তবে দুঃখের মধ্যেও তাঁর সান্ত্বনা ছিল। কারণ, তাঁর পর বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ। সে তাে গৌরবের। অপরদিকে, প্রবীরের মৃত্যুতে পিতা নীলধ্বজ ভীত হয়ে পড়লেন। পান্ডবদের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ করার সাহস তাঁর হল না। তিনি বশ্যতা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত হলেন। এমন অবস্থায় জনা স্বামীকে পুনরায় যুদ্ধ করার জন্য উৎসাহ দিতে লাগলেন।
তিনি বললেন, হে রাজা আপনি চিন্তা করে দেখুন। একদিকে পান্ডবরা আমাদের পুত্রকে হত্যা করেছে। অপরদিকে দেশের স্বাধীনতা হরণ করেছে। সুতরাং তারা আমাদের শত্রু; দেশের শত্রু। তাদের ক্ষমা করা যায় না। এদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। আপনি কি ধর্মের কথা ভুলে গেছেন? দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ তাে ধর্মযুদ্ধ। আর এ ধর্মযুদ্ধ না করলে পাপ হয়। ধর্মযুদ্ধে প্রাণ গেলে স্বর্গলাভ, আর জয়ী হলে রাজ্যলাভ। এ যুদ্ধ করার সুযােগ পাওয়া সৌভাগ্যের কথা। সুতরাং দেশ আক্রমণকারী ও পুত্রহত্যাকারীর নিকট বশ্যতা স্বীকার করবেন না। অর্জুনকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করুন। পুত্র হত্যার প্রতিশােধ নিন।” একথা বলে জনা স্বামী নীলধ্বজকে যুদ্ধ করতে অনুরােধ জানালেন।
কিন্তু জনার উৎসাহপূর্ণ বাক্য শুনেও নীলধ্বজের যুদ্ধ করার সাহস হল না। তিনি পান্ডবদের বশ্যতা স্বীকার করলেন। এই ঘটনায় জনা খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি শােকে দুঃখে আর প্রাণ ধারণ করতে চাইলেন না। এক দিকে পুত্র শােক, অপরদিকে দেশের পরাধীনতা জনাকে ব্যথিত করে তুলল। তিনি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
হিতােপদেশ: মনে রাখবে, পরাধীনতার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।