১৯৪৭, 13 ই আগস্ট রাত্রে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ এর পরে, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত টেলিফোনের জহরলাল নেহেরু কে ছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানে তার জন্মভূমিতেই থাকবেন, জানিয়েছিলেন সবাই যদি ভারতে চলে যায় তাহলে এই দেশটার কি হবে।
তার মত বড় ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের কাছে সুযোগ ছিলো দেশভাগের সময় সহজেই ভারতে চলে গিয়ে বড় রাজনৈতিক জীবন, সরকারের রক্তচক্ষু মুক্ত জীবন গড়ার, খুব আরামে বিশাল বড় পদে থাকতে পারতেন । তার কি কোনো দরকার ছিলো অযথা কষ্ট করে পাকিস্তানে থেকে দুইদিন পর পর খোদ সরকারের কাছ থেকে দালাল শব্দ শোনার? না। কিন্তু তিনি ভালোবাসতেন তার জন্মভূমিকে, তার কুমিল্লা – ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের সহ বাংলার মানুষদের, যার জন্য তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশুর মত নির্মমভাবে হত্যা করে।
সেদিন পাকিস্তান গনপরিষদের অধিবেশনে বাংলার পক্ষে কথা বলার মত বেশি কেউ ছিলেন না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সাহস করে বাংলার পক্ষে কথা বলেন ১৯৪৮ এর গনপরিষদে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা সেদিন চুপ করে বসেছিলেন। সেই চুপ করে থাকাটাই যেনো তাদের জন্য কাল হয়ে দাড়ায় পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভয়াবহ ভরাডুবি হয়। সেই যে ভরাডুবি হয়, আর কখনো উঠে দাড়াতে পারেনি।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেদিন বলেন গনপরিষদে।
I know, Sir, that Bengali is a provincial language, but, so far our State is concerned, it [Bengali] is the language of the majority of the people of the state [of Pakistan]. So although it is a provincial language, but it is a language of the majority of the people of the State and it stands on a different footing therefore. Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this State, 4 crores and 40 lakhs of people speak the Bengali language. So, Sir, what should be the State language of the State (of Pakistan)? The State language of the State (of Pakistan) should be the language which is used by the majority of the people of the State, and for that, Sir, I consider that Bengali language is a lingua franca of our State.”
তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের গনপরিষদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সহ বেশিরভাগ সদস্য দালাল বলেন, পূর্ব বাংলার সদস্যরা হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকিরা চুপ ছিলেন। যারা তাকে সমর্থন দেন তারা ছিলেন,
Hari Barman, Bhupendra Kumar Dutta, and Sris Chandra Chattopadhyaya.
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা-বিতর্কে শেষ বাক্যটি হচ্ছে ‘The Motion was negative.’
কিন্তু সেই negative-ই কতোখানি positive হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেলাম কয়েকদিন পরেই। করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশন শেষে পূর্ব বাংলার সদস্যরা ঢাকা ফিরলেন। তেজগাঁ বিমানবন্দর। তেমন কোনো নিরাপত্তা বা প্রহরা নেই; পূর্ববঙ্গের সংসদ সদস্যরা বিমান থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধীরেন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন মূল গেটের কাছে কিছু যুবক চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ অংশটি এখানে উদ্ধৃত করা অপরিহার্য মনে করছি। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘স্মৃতিঃ ১৯৭১’-এর তৃতীয় খন্ডের প্রথম রচনাটিই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্তের। ধীরেন দত্তকে উদ্ধৃত করে লিখছেন আরমাঃ “প্রথম গণ-পরিষদ অধিবেশন শেষে করাচী থেকে ফিরলাম। অনুন্নত তেজগাঁ বিমান বন্দরে সিকিউরিটি বলতে কিছুই নেই। প্লেন থেকে নেমে দেখলাম, প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশজন যুবক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে চাদর। আমার ধারণা হলো, গণ-পরিষদে বাংলার সপক্ষে কথা বলার দরুণ এরা বিক্ষোভ জানাতে এসেছে, এদের চাদরের আড়ালে অস্ত্রও থাকতে পারে। সংশয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যখন ওদের একেবারে নাগালের মধ্যে চলে গেছি তখন হঠাৎ প্রত্যেকে চাদরের তলা থেকে রাশি রাশি ফুল বের করে আমার ওপর বর্ষণ করতে লাগলো। ওরা সবাই ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।”
সেইদিন যদি সদ্য ধর্মের নামে ভাগ হওয়া পূর্ব বাংলায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ফুলের বদলে লোকজন এয়ারপোর্টে এসে হুমকি ধামকি দিতো যা তিনি সন্দেহ করেছিলেন, তাহলে হয়তো খুব বেশি মানুষ সাহস করতো না পরবর্তীতে এই আন্দোলন করার।
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব বাংলার মন্ত্রীও নির্বাচিত হন যুক্তফ্রন্ট সরকারের। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর তাকে এক প্রকার নজর বন্দি করে রাখে পাকিস্তান সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিলো ৮৫, যুদ্ধ করার সামর্থ্য না থাকলেও শেষ বয়সেই পাকিস্তান তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা করে তার আগের ভূমিকার জন্য। তাকে ও তার ছেলে দুইজনকেই হত্যা করে পাক বাহিনী।
পাক বাহিনীর রক্তগঙ্গার অন্যতম শিকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কী অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, এক সাক্ষাৎকারে সেই বিবরণ দিয়েছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নাপিত রমণীমোহন শীল। রমণীমোহন শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো পাকিস্তানী মিলেটারিদের প্রয়োজনেই, কারণ তাদের মৃত্যু হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের চুল দাড়ি কাটার মতো কোনো লোক থাকবে না।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তা দেখে কোন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের চোখের জল সংবরণ করা সম্ভব নয়। সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়ঃ “ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানে নি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জেজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বারবার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়-নিজের কাজ কর।’ এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।” (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ: পৃষ্ঠা
মানুষ’ হওয়ার প্রধানতম শর্ত কী? আমরা ধীরেন দত্তের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, দেশপ্রেমের পরীক্ষায় তিনি শর্তহীনভাবে উজ্জ্বলতম সফলতা লাভ করেছেন, কারণ দেশভাগের পর তাঁরই অনেক আপনজন ভারতে চলে গেছেন, বন্ধুরা দেশত্যাগী হয়েছেন। কিন্তু তিনি যাননি, গেলে নিঃসন্দেহে একটা সম্মানজনক অবস্থান তিনি লাভ করতেন, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতেন, আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করতেন, মন্ত্রিত্বও লাভ করতেন। কিন্তু দেশের মাটির সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ তিনি করেননি। না করার ফলে তাঁকে প্রায়ই জেলে যেতে হয়েছে, রাজবন্দী হিসেবে থাকতে হয়েছে, গৃহবন্দীও থেকেছেন একাধিকার। তবু তিনি দেশ ছাড়েন নি।
কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরা কতোদূর? গোমতী নদী পার হয়ে কিছু দূর গেলেই ত্রিপুরা সীমান্ত, আর সেখানে পৌঁছলেই নিরাপদ। কিন্তু আমরা আরমা দত্তের লেখা থেকে জেনেছি, ধীরেন দত্ত মাতৃভূমি ছাড়েন নি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, তার রক্তের উপর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়বে, চেয়েছিলেন তিনি নিজ হাতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করবেন। আশ্চর্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন শহীদ ধীরেন দত্ত। এ-দেশ যে তাঁরই জীবদ্দশায় স্বাধীন হবে, সে-ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। এই বিশ্বাস পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়।
মানুষটিকে চিনবার জন্যে আমাদের অনেক পথ, পথের বাঁক অতিক্রম করলে তবেই চেনা যাবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তিনি কীভাবে দেশটা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
তার কুমিল্লায় স্টেডিয়াম আছে, বিশ্ববিদ্যালয় হল আছে, সড়ক আছে, চত্বর আছে, লাইব্রেরি আছে, আরো অনেক জায়গায় অনেক কিছু আছে। তার অবদান জনগণ স্মরণ করবে সবসময়, যেইরকম বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখে গিয়েছিলেন বিজয়ের ৪৯তম বছরে তা হয়তো অধরাই থেকে গিয়েছে কিনা সেটা,
আমার বাংলাদেশি বন্ধুরা ভালো বলতে পারবেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং তার নাতনি বর্তমান বাংলাদেশের সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত কে দেখা যাচ্ছে।