নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে একটি দাবি ছিল
নতুন শিক্ষাপদ্ধতির অনেকগুলো দিকই ভাল হয়েছে। শুধু ধর্ম বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা রয়েছে। এখনো ধর্ম বইতে যার যে ধর্ম শুধু তাই পড়ানো হবে। আমার প্রস্তাব হল-ধর্ম বই হোক এক ধরনের। সেই ধর্ম বইতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খৃস্টান ধর্ম নিয়ে প্রধান চারটি অধ্যায় ও আরেকটি অধ্যায়ে আরো প্রধান ১০টি ধর্ম সম্পর্কে অল্প বিস্তর লেখা থাকুক। তাতে প্রত্যেকেই সকল ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারবে। তাতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষও কমে আসবে। তারা অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মানুষ হয়ে উঠবে।
এই শিক্ষাপদ্ধতিও অলৌকিকতা নির্ভর৷ আমি জানি এখানেও শেখানো হবে না- মানুষের আদি অবস্থা থেকে আজকের অবস্থায় আসার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, আদিম গোত্র সাথে আজকের রাষ্ট্র গঠন, ধর্মের উৎপত্তির কারণ ও সাম্প্রদায়িকতা, প্রেম-ভালবাসা কি ও কেন অনুভূতি তৈরি হয়, যৌনতা কি, বিবাহ ও যৌন নৈতিকতা কি, কিভাবে সন্তানের জন্ম হয়, পুঁজিবাদ কিভাবে বৈষম্য তৈরি করে, রাষ্ট্র কিভাবে নাগরিকদের নিষ্পেষণ করে, সরকারের জবাবদিহিতা ও ভোটের গুরুত্ব …! মেকলের শিক্ষানীতি ছিল ভারতীয়দের কেরাণি বানানোর জন্য৷ আজও দেখি মুখস্তনির্ভর শিক্ষা ব্যাবস্থা৷ এতে চিন্তা ও মেধার বিকাশ তেমন ঘটে না৷ সবাই যেন প্রথা ও রীতির দাসত্বে থাকে সেভাবেই নাগরিকদের গড়ে তোলা হয়৷ মুক্তচিন্তাকে অবরুদ্ধ করেই রাখা হয়৷
তবুও কিছু ভাল দিকের কথা বলি:
১। নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে বিদ্যমান পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির পাবলিক সমাপনী পরীক্ষা- পিইসি ও জেএসসি বাতিল হবে। এটা অবশ্যই একটি ভাল সিদ্ধান্ত। শিশুদের পাবলিক পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিয়ে পরীক্ষা-ভীতির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ভালবাসার পরিবর্তে ঘৃণা আর সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতাই হয়ে উঠেছিল মূল৷
২। নবম শ্রেণিতে থাকবে না সায়েন্স, আর্টস, কমার্স নামে বিভাগ বিভাজন। বিজ্ঞানের ছাত্ররা এখন অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা রাখে না। আবার মানবিক ও বাণিজ্যের ছাত্ররাও বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে না। সেই সংকট কিছুটাতো কাটলো। এখন এসএসসি পাশ একজন কর্মচারীও মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান নিয়ে ধারণা রাখবে৷
৩। সময় নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দশম শ্রেণির পাঠ্যবিষয়ের ওপরই হবে এসএসসি পরীক্ষা। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে এই নতুন কারিকুলাম। ওই বছর প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম, নবম, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণি এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে পরের বছর হবে নতুন বই।
৪। নতুন শিক্ষাক্রমে বই এবং পরীক্ষা পদ্ধতি বদলে যাবে এবং শিখন কৌশলেও নানা পরিবর্তন আসবে। এখন যেভাবে মুখস্থবিদ্যা চলছে, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটি কিছুটা কমে আসবে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষাক্রম আসছে তা আয়ত্তে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক মেধার প্রয়োগ বাড়বে। মেধার বিকাশ হবে এতে।
বিষয়গুলোও কিছুটা আধুনিক:
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকরা শেখাবেন। প্রাথমিকের জন্য আটটি বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে ‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না। এসব শিক্ষকরা শেখাবেন, এ জন্য নির্দেশনামূলক বই দেওয়া হবে। আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
দশম শ্রেণির ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান) সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ ও শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশসহ উভয়ের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা হবে। অবশিষ্ট ৫টি থিমভিত্তিক বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিখনকালীনই ১০০ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে। ৯ম-১০ম শ্রেণির মূল্যায়ন হবে ৫০ নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ নম্বরের। ৪র্থ-৫ম ও ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বরের এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ নম্বরের। ১ম-৩য় শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বরের। কোনো পরীক্ষা হবে না। অনুরূপ প্রাক-প্রাথমিকেও ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা হবে ৭০ শতাংশ। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয় শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। এছাড়া নৈর্বাচনিক, বিশেষায়িত কাঠামো, প্রকল্পভিত্তিক, ধারণানুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক ও ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
এসব তেমন কোন কাজেই আসবে না যদি না গাইড বই বন্ধ করা যায়। নিষিদ্ধ গাইড বইই আজ প্রসিদ্ধ। স্কুলগুলো গাইড বই বিক্রেতাদের হাতে বন্দি হয়ে আছে। তারা টাকা দিয়ে কমিটি কিনে নেয়। শিক্ষার্থীদের বাধ্য করে গাইড কিনতে। আবার এতে শিক্ষকরাও পড়াতে পারে সহজে। তাদের কোন বেগ পেতে হয় না। আরেকটি কাজ করাতেই হবে তাহল প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা। এটাতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যগুলো মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। প্রাইভেট পড়ানোর জন্য শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাসে পড়াতে চায় না। এ দুটি বিষয় বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারের খরচ বাঁচাতে বইর পরিবর্তে এখন শিক্ষার্থীদের ট্যাব/ল্যাবটব দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষগুলোও করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর।