নাম পাল্টানোর মাঝে এক গভীর মাহাত্ম্য আছে।
আজ নাম পাল্টে যাবে, কাল পুরনো নাম ইতিহাস হবে, পরশু লোকে ইতিহাস ভুলে যাবে।
দ্বিতীয় ছবিটি দুইদিন আগে পোস্ট করেছিলাম। যে পাহাড়ে পতাকা বসিয়েছে সেটাই চন্দ্রনাথ পাহাড়, আর পাহাড়চূড়ায় যেখানে পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ঐ জায়গাতেই চন্দ্রনাথ মন্দির।
বাংলাদেশে হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি মন্দির/তীর্থ আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির এটি। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শিবচতুর্দশী তিথিতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় দুই-তিন লাখ লোক আসে চন্দ্রনাথে।
চন্দ্রনাথ মানে শুধু চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে থাকা চন্দ্রনাথ শিব নয়; পুরো সীতাকুণ্ড জুড়েই অনেকগুলো পাহাড় এবং মন্দির মিলে চন্দ্রনাথ তীর্থক্ষেত্র (শেষ ছবির মানচিত্রে, কয়েকশ বছর আগে কোন এক ঋষি দ্বারা অঙ্কিত বলে মনে করা হয়)।
দেবীপুরাণ মতে, ত্রিগুণাত্মক ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসের দেবতা শিব যখন তাঁর স্ত্রী সতীর মরদেহ কাঁধে করে দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণু সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষার্থে তাঁর হাতের সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। খণ্ডকৃত সতীর দেহের মোট একান্নখণ্ড যেসব স্থানে পতিত হয় সেখানেই হয়ে ওঠে একান্ন শক্তিপীঠ। ঐ একান্ন খণ্ডের মাঝে একটি খণ্ড এ চন্দ্রনাথে পাহাড়চূড়ায় পড়ে, এবং এখানেও হয়ে ওঠে শক্তিপীঠ।
পরবর্তীতে নেপালের জনৈক রাজা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পাহাড়চূড়ায় যেখানে চন্দ্রনাথের অবস্থান ঐ জায়গায় মন্দির স্থাপন করেন।
আবার, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ অনুসারে, এই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সঙ্গে রাম-সীতার কাহিনীও জুড়ে রয়েছে। শ্রীরামচন্দ্র যখন পিতৃসত্য পালনের জন্য স্ত্রী সীতা ও ছোট ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশ্যে বের হন, তাঁরা এই অঞ্চলে মহামুনি ভার্গবের আশ্রমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন মহামুনি ভার্গব সীতাদেবীর স্নান ব্যবস্থার জন্য এক কূপ খনন করেন যা সীতাকুণ্ড নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই থেকে ঐ অঞ্চলের নাম হয় ‘সীতাকুণ্ড’।
তীর্থস্থান হলেও গত কিছু বছরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পর্যটনের নামে জনসমাগম বৃদ্ধি পায়। জনসমাগম বাড়লেও এতদিন কারো ভূতি-অঙ্গে এত আঘাত লাগেনি যে চন্দ্রনাথে ‘বিজয় পতাকা’ (কোন ধরনের বিজয়ের কথা বলছেন ঐ উগ্রবাদিরাই ভালো জানে) ওড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত বছরখানেক ধরে তাঁদের অন্তরে বিজয় পতাকা ওড়ানো ও ধর্মশালা স্থাপনের প্রবল ইচ্ছা জন্মেছে।
এবং উপর্যুপরি তাঁরা পতাকা ওড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন, এবং একের পর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও অন্যদের উসকে দিচ্ছেন।
তাই জানতে ইচ্ছা করছে, এত বছর ধরে একটা তীর্থস্থানকে পর্যটনে রূপান্তর করা সত্ত্বেও কখনো কি কেউ বাধা দিয়েছিল? কখনো কি কেউ বলেছিল আপনারা উপরে উঠতে পারবেন না? ঘুরতেও যেতে হবে, আবার ঐ তীর্থকে শিরকি জায়গা বলে তাচ্ছিল্য করে ‘বিজয় পতাকা’ ওড়ানোর তোড়জোর করতে হবে, এমন যদি হয় তাহলে কী দরকার আছে একটা তীর্থস্থানে ঘুরতে যাওয়ার? কী দরকার সেখানে গিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি প্রয়োগের চেষ্টার?
‘জোর যার মুল্লুক তার’ কি পাহাড়ের উপরেও দেখাতে হয়?