না, পুরো চন্দ্রনাথ পাহাড় আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার সম্পত্তি না। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আসা দেশের প্রশাসনের হরেক রকম আইনের ফেরে চন্দ্রনাথের একদিকে আছে সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক। সেখানে মসজিদ আছে। আমিষি চিপস বার্গারের দোকান সব আছে। সেলফি তোলার জায়গা আছে। ওদিকে আমরা তীর্থযাত্রী কেউ যাইও না। আপনারা সেদিকে যা খুশি করেন, কেউ দেখবেও না।
কিন্তু মহাদেবপুর গ্রামের রাস্তা থেকে পবিত্র চন্দ্রনাথ চূড়া পর্যন্ত আমার তীর্থক্ষেত্র! ভোলানন্দ গিরি আশ্রম, রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির, ইসকন মন্দির, গিরীশ ধর্ম্মশালা, ননী গোপাল সাহার বানিয়ে দেওয়া ধর্ম্মশালা, স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিতে করা পঞ্চবটী, স্বামী অদ্বৈতানন্দের তপোবন আশ্রম, মহর্ষি ব্যাসদেবের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ব্যাসকুণ্ড, সারা বাংলাদেশের গীতাযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্র শংকর মঠ, অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ আশ্রম, সাধক রাম ঠাকুরের মন্দির, সীতাদেবী কুণ্ড, মা ভবানী শক্তিপীঠ, শ্রী শম্ভুনাথ মন্দির, শ্রী রাম সীতা লক্ষ্মণ মন্দির, শ্রী নারায়ণ মন্দির, শ্রী অন্নপূর্ণা মন্দির, শ্রী দুর্গা মন্দির, শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির, সবশেষ শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ মন্দির — আমার তীর্থক্ষেত্র!
যুগযুগান্তরে শত প্রলোভন, ভয়, বিভ্রান্তিকে উপেক্ষা করে এখানের ভূমিপুত্র আমার পূর্বজরাই সনাতন আদর্শকে বহন করে এই পাহাড় অতিক্রম করে দেবাদিদেবের চরণে প্রণতি জানিয়েছে। এখানে এর অবমাননাকর কাউকে বরদাশত ঐ দালালে ভরা স্রাইন কমিটি করতে পারে, একজন হিন্দু করতে পারে না।
আর যারা বলছেন, তাহলে মসজিদের আশেপাশে মন্দির, কীর্তন করতে দিবেন না… এমনিতেও কত দেন। আরেকবার বলি, মাথায় ঘিলু থাকলে বুঝবেন।
সব মসজিদই যেমন আল্লাহর ঘর, তেমনি সব মন্দির দেবস্থল, যদিও সনাতন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সবকিছুই পরমব্রহ্মে অবস্থিত, তিনি সর্বত্র বিরাজমান।
কিন্তু তারমধ্যেও পবিত্র কাবা শরীফ, নবীজি (স.) এর রওজা শরীফ যেমন মুসলমানদের তীর্থক্ষেত্র বা পবিত্র জায়গা, অমুসলিমদের সেসব স্থানের প্রতি শ্রদ্ধা আছে কি নেই, সেটা অনিশ্চিত বলে সেসব জায়গায় অমুসলিম প্রবেশ করতে দেয়া হয়না।
বুদ্ধদেবের জন্মস্থান বুদ্ধগয়াতে বোমা বিস্ফোরণের পর জানিনা এখন অবৌদ্ধদের ঢুকতে দেয় কিনা, কিন্তু থাইল্যান্ড- কম্বোডিয়ার জোরে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের অনেক মন্দিরে অবৌদ্ধ ঢোকা নিষেধ করেছে। সর্বশেষ আমি মহেশখালী বিহারে ঢুকতে পেরেছিলাম আমার মা সাথে ছিল বলে, হিন্দু বলে বিশ্বাস করেছে।
আর খ্রিস্টানিটির কথা যদি বলতে হয় তাহলে আপনাকে রেঁনেসা বা ওসব অঞ্চলের কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। যেজন্য ক্যাসিয়াস ক্লে মুসলিম হলেও, জর্জ হ্যারিসন হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী হলেও কারো প্রাণহানি হয়নি। মিশিগান স্টেটে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, সানফ্রান্সিসকোতে রথযাত্রার দিন সরকারী রাজ্য ছুটি হয়েছে। হ্যাঁ, সেখানে ডানপন্থী হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট গ্রুপ হিন্দুদের বিরুদ্ধে সেদিনও এক সেমিনার করার আয়োজন করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধেও আছে। কিন্তু প্রশাসনের নজরে এলে তারা ঐ সেমিনার হওয়ার আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। আবার লিবারেলিজম ধর্মবিরুদ্ধ সমকামিতা, গর্ভপাতও প্রমোট করে, লিভ টুগেদারকে ডিফেন্ড করে, এটা মাথাতে রেখে – ধর্মের জ্ঞান দিয়ে এদের মনোবৃত্তি বদলানো যাবে ভেবে আমি এই কথাগুলো বলছি।
তো সেরকম পটভূমি এখানে তৈরি হতে দেওয়া হচ্ছে কী? তৈরি করতে সবার সমান অংশগ্রহন লাগলেও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানদের দায়িত্ববোধই এখানে বেশি।
এখন আপনি যদি হেফাজতের ঐ লোকটার মত বলেন, ইন্ডিয়াতে রাষ্ট্রধর্ম চাইনা, কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামী শাসন চাই কারণ অন্য ধর্মগুলো ভিত্তিহীন- তেমনি ষাট গম্বুজ মসজিদের ওখানে হরেকৃষ্ণ কীর্তন, হালেলুইয়া বলা যাবে না কিন্তু চন্দ্রনাথ তীর্থক্ষেত্রে আজান দেওয়া যাবে, ইসলামের পতাকা ওড়ানোর কথা বলা যাবে, মসজিদের দাবি করা যাবে—
কিংবা আপনি নাস্তিক, মহাদেবের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, স্নান না করে- আমিষ খেয়ে তীর্থে উঠবেন, যেমন ইচ্ছে তেমন বসবেন, ছবি তুলবেন, তাহলে সত্যিই আমার আপনাকে বলার কিছু নেই। আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিন। মনে রাখবেন, ইজরায়েল রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বৈধতা আপনি দিচ্ছেন।
আর এসব কর্মকাণ্ড করে বিশ্বাস দুর্বল করবেন?