“পড়েছি মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে”
যশোরের সেনানায়ক খান জাহান আলীর একজন হিন্দু কর্মচারী মুসলমান নারীর প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। মুসলিম হবার পর তার নাম রাখা হয় তাহির খাঁ। পশ্চিমবঙ্গের “পিরল্যা” গ্রামে তার জন্মস্থান বিধায় তাকে “পিরল্যা খাঁ” নামেও ডাকা হত। মুসলমান হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ তাহির খাঁ-কে যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগনায় যখন খান জাহান আলীর দখলে আসলে তাকে চেঙ্গুটিয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।
এই চেঙ্গুটিয়াতে একদিন একটি অতি সাধারণ রসিকতা ইতিহাসে এমন একটি ক্ষতের সৃষ্টি করেছিলো যা ধর্মান্তর করার মিশনারী একটি ধর্ম আরেকটি চরম জাতপাতের কুসংস্কারগ্রস্ত ধর্ম মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। চেঙ্গুটিলায় কামদেব ও জয়দেব নামের দুই ভাই দেওয়ানের কাজ করত। তাহির খাঁ একদিন রোজার দিন দিনের বেলা লেবু হাতে নিয়ে তার ঘ্রাণ নিচ্ছিল। তখন কামদেব অথবা জয়দেব তাহির খাঁ-কে রসিকতা করে বলে, ঘ্রাণে অর্ধভোজন, কাজেই তাহির খাঁর রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে। সামান্য এই রসিকতাকে তাহির খাঁ সহজভাবে নিলেন না। তিনি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের নিমন্ত্রণ করলেন ভোজের। সবাই যখন উপস্থিত তখন চাকরকে ইশারা করে। গরুর মাংস ভর্তি বড় বড় হাড়ি উনুনসহ এনে সভার সামনে রাখা হলো। গরুর মাংসের ঘ্রাণ পেতেই নিমন্ত্রিতরা নাকে কাপড় চেপে সভাস্থল ছেড়ে পালালেও সুখদেব ও কামদেবকে তাহির খাঁ চেপে ধরেন এবং বলেন ঘ্রাণের অর্ধভোজনে তাদেরও গো-মাংস খাওয়া হয়ে গেছে এবং আজ থেকে তারা মুসলমান…।
ধর্মান্তরিত হয়ে দুই ভাইয়ের নাম হয় যথাক্রমে জামাল উদ্দিন ও কামাল উদ্দিন। এদিকে এই দুই ভাইয়ের “অপরাধে” ব্রাহ্মণ সমাজ তাদের পুরো জ্ঞাতী গোষ্ঠিকে একঘরে করে ফেলে। তাদের পরিচয় হয়ে উঠে “পীরল্যা বামুন” যা অপভ্রংশ হয়ে পরবর্তীতে “পীরালি ব্রাহ্মণ” হয়। এই পীরালি বামুনদের ঘরের মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য বর খুঁজে পাওয়া যেত না। খুঁজে খুঁজে “পীরালি বামুন” ঘরের বর কনে ঠিক করা হত। এরকম এক পীরালি বামুন ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী। ইনি হচ্ছে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের বিখ্যাত ঠাকুর বংশের অন্যতম আদিপুরুষ। জগন্নাথ কুশারী পীরালী বামুন বিয়ে করায় তিনি পিঠাভোগ ছাড়তে বাধ্য হন! কুশারী পদবী ঢেকে যায় উত্তরপুরুষ পঞ্চানন কুশারীর প্রবলমাত্রায় ধার্মিকতা ও আচার নিষ্ঠার কারণে। তাকে ডাকা হত “ঠাকুর মশাই” এভাবেই কুশারী পদবী ঢেকে যায় ঠাকুর পদবীতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের পূর্বপুরুষ রান্নার ঠাকুর ছিলেন বলে যে ইতিহাস বাজারে প্রচলিত তার কোন ভিত্তি নেই।
পীরালী বামুন পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গের বহু স্থানে দেখা যায়। বাংলা প্রবচনটি “পড়েছি মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে” এর বয়সও মোটামুটি বাংলায় মুসলিম শাসন থিতু হয়ে বসার সময়ই। তবে এখানে মুঘলদের নাম আসাটায় মনে করার কোন কারণ নেই এরকম গরুর মাংস খাইয়ে হিন্দুদের কুখ্যাত “জাতমারা” কেবল মুঘলরাই করেছিলো। তবে তাহের খাঁর মাধ্যমেই ইতিহাসের বিখ্যাত ‘পীরালি ব্রাহ্মণ’ বলতে আমরা যা বুঝি তার সূচনা হয়েছিল বলা যায়। “মুঘলদের সঙ্গে এক টেবিলে খাওয়া” ও ব্রাহ্মণদের সমাজচ্যুতের ঠেলায় বাংলায় ব্রাহ্মণ ক্ষৈত্রিয়ের কি হাল হয়েছিলো মধ্যযুগের কবিতায় কিছুটা পাওয়া যায়। যেমন- “পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যবেত যবন।/উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।/ব্রাহ্মণ জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।/বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।“
“পড়েছি মুঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে” বাংলা এই প্রবচনটি ভয় ভীতি ও চাপের মুখে অনিচ্ছায় যে কাজ করতে হয় সেটা বুঝানো হয়েছে। কেউ আপনাকে না খাইয়ে ছাড়বে না তাকে কি করে নেগেটিভভাবে দেখা হচ্ছে? এমন কাউকে তো খুবই অমায়িক অতিথিবত্স হিসেবে ধরা হয়। তাহলে মুঘলদের খেতে বলাটা কেন আতংকের? এই হচ্ছে মোটামুটি তার ইতিহাস।
[সূত্র: সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা-১, নাসির হেলাল, সুহৃদ প্রকাশন,/ রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর বাড়ীর ইতিকথা, সৈয়দা মকসুদা হালিম/ যশোহর খুলনার ইতিহাস. ১ম খন্ড ৩৩৩ পৃষ্ঠা, শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র, /সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা-এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)]