পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হোক ধর্ম, তার দণ্ডনীতি

অনিমিত্র চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ ভারত

কথিত আছে, জাপানে নির্বাসনের সময় নিজস্ব গৃহের সংলগ্ন বাগানে উনি বেশ কয়েকটি গাছ পুঁতেছিলেন। এবং প্রত্যেকটি গাছ ছিল তাঁর ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের ঊষালগ্নের সহকর্মীদের নামে; উনি সেই স্থানে প্রতিদিন নিয়ম করে ধ্যানস্থ হতেন। ধর্মপ্রাণ ছিলেন। ধর্মই ছিল তাঁর আত্মাস্বরূপ, সামগ্ৰিক সংগ্রামী প্রেরণার একমাত্র উৎস।

বঙ্গের সশস্ত্র বিপ্লবের পঞ্চ মহাক্ষত্রিয়ের অন্যতম তিনি। তাঁর চিন্তা, কর্মপ্রণালীতে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত। বারাণসী থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে চন্দননগর, চন্দননগর থেকে সুদূর পূর্ব বঙ্গের শহর, গ্রামাঞ্চল যেখানেই তাঁর উপস্থিতির সম্ভাবনা দেখা যেত ঝাঁপিয়ে পড়তো ব্রিটিশ সরকার তার সমস্ত শক্তি সমেত। উদ্দেশ্য একটিই – এই ভয়ঙ্কর শত্রুকে গ্রেপ্তার নয়, আইনী বিচারের প্রহসনের প্রদর্শনও নয় – একবারে প্রথম গুলিতেই তাঁর ভবলীলা সমাপ্ত করা। পৃথিবী-বিখ্যাত হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিকে কি হস্তের বাইরে রাখা শোভা পায় ব্রিটিশের, বিশেষত সেই যুগে যখন দিনের সূর্য অস্ত গেলেও, ব্রিটিশ সূর্য থাকে স্বমহিমায় তেজোদৃপ্ত!!কিন্তু এও এক আশ্চর্য – কোনদিনই তিনি ধরা পড়েন নি। ছদ্মবেশ গ্রহণে তাঁর এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। সাধক মহাক্ষত্রিয় বিপ্লবী শ্রী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতম সতীর্থ তিনি; তাঁকে ধরা কার সাধ্য!! এই একই ক্ষমতার সাহায্যে ডিসেম্বর ২৩, ১৯১২ তে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটালেন – দিল্লীতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা নিক্ষিপ্ত হল – করলেন তাঁরই শিষ্য শ্রী বসন্ত বিশ্বাস।

তাঁর পরবর্তী অধ্যায় – সুদূর জাপানে যেখান থেকে তিনি মাতৃভূমির শৃঙ্খলামোচনের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন প্রতি মুহূর্তে। চন্দননগর থেকে প্রকাশিত তাঁর বিপ্লবী সতীর্থ শ্রী মতিলাল রায়ের সম্পাদনায় “প্রবর্তক” পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন তাঁর স্মৃতিকথা। তাঁর আগ্নেয় লেখনীর মধ্য দিয়ে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের বহু অকথিত কাহিনী, ব্রিটিশের অত্যাচার ও তাঁর অখ্যাত, নিহত বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের মহামূল্যবান তথ্য প্রকাশিত হয়। যার দরুন ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে চন্দননগরের তৎকালীন ফরাসী গভর্নর নিষিদ্ধ করেন “প্রবর্তক” পত্রিকার প্রকাশনা। তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সাথে। শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সচিব শ্রী বাল সাভারকরের ১৯৫৪ সালে দ্বারা প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী – (১৯৩৮ – ১৯৪০) সমগ্র ভারতবর্ষে সাভারকর ভ্রমণ করেন হিন্দু মহাসভাকে শক্তিশালী করার জন্য। একই সময়ে শ্রী বসুও জাপানে হিন্দু মহাসভার একটি শাখা উদ্বোধন করেন ও সর্বসম্মতিক্রমে তার সভাপতি নির্বাচিত হন।

শ্রী বাল সাভারকর লিখছেন (June 2, 1954) – “Sri Rashbehari Bose was the president of the Hindu Mahasabha, Japan. While during the years 1938 to 1940 Savarkarji had been presiding over the All India Hindu Mahasabha, Sri Rash Behari Bose too continued to preside over the Japan branch of the Hindu Mahasabha. After the release of Veer Savarkarji from his internment at Ratnagari in 1937 Sri Bose wrote to him occasionally on the advisability of the Hindu Mahasabha movement and as the result of the correspondence between them Sri Bose started a branch of the Hindu Mahasabha under his own presidentship. The correspondence between them continued right up to the declaration of war by Japan and the formation by Sri Bose of the INA (Indian National Army) in Japan even before Netaji Subhas Babu could reach Singapore.” [Sources: “Two Great Indian Revolutionaries – Rash Behari Bose and Jyotindra Nath Mukherjee” by Sm. Uma Mukherjee and “The Two Great Indians in Japan” by JG Ohsawa]   

আরও পরবর্তী অধ্যায় বা ইতিহাস? ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ইতিহাস যা ক্রমান্বয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হস্তে অর্পণ করা হয়। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি তার কিছু দিন পরেই। তাঁর নিজস্ব উক্তি, “I was ever a fighter. One fight more, the last and the best…. ” পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় অবশেষে।  

তাঁর সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে দুঃসাহসিক কর্মের মধ্য দিয়ে। বিশ্রাম তিনি পাননি ক্ষণিকের তরেও – তাঁর চেতনার গহন কোণে বিরাজ করতো সদা মাতৃভূমির শৃঙ্খল ও অপার লাঞ্ছনা। তাঁদের সেই যুগ কবেই সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু তার সাথেই ‘মুহূর্তম জ্বলিতং শ্রেয়, ন চ ধুমায়িতং চিরম” র প্রতিচ্ছবি Masculine Hinduism ও নাশ হল বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে। আজ হঠাৎ আবির্ভূত হলে নিশ্চিতভাবে এই ‘৪৭-পরবর্তী দীন, হীন, ক্লীশ হিন্দুদের চিনতে পারবেন না তিনি। তিনি আশ্চর্য হবেন দেখে কেন এত বঞ্চনা, অত্যাচার শতধা-বিচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হয়। মূল কথা তিনিও জানবেন, বাঙ্গালী হিন্দু মননের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক প্রকাশ – অনুশীলন সমিতির তত্ব ও তার বাস্তবায়নের সুপ্রচেষ্টা পরাস্ত ও নিঃশেষ করা হয়েছে এক সুগভীর ধর্মদ্বেষী চক্রান্তের দ্বারা।

আজ মহাবিপ্লবী শ্রী রাসবিহারী বসুর প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর চরণে একটি আন্তরিক ইচ্ছা নিবেদন করি – পুনর্জন্ম নিন তিনি এই বঙ্গে, এ ধরায় ন্যায়ের দণ্ড রুদ্র দীপ্ত মূর্তিমান রূপে। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হোক ধর্ম, তার দণ্ডনীতি।

প্রণাম। ……………………

লেখক: অনিমিত্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *