পৃথিবীর অর্ধেক কণাই তাঁর নামে
=============================
পৃথিবীর তাবৎ মৌলিক কণার অর্ধেকের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে।এই বিরল প্রতিভাধর মানুষটির-র নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪ – ১৯৭৪)। বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁর অবদান জগৎস্বীকৃত। তাঁর ‘সংখ্যায়নসূত্র’ একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ‘বোস-সংখ্যায়ন’ (বোস-স্ট্যাটিসটিক্স) তাঁর অক্ষয় কীর্তি। এই কীর্তি সত্যেন্দ্রনাথের বিশ্বজোড়া কালজয়ী খ্যাতি এনে দেয়।
সত্যেন্দ্রনাথের কাজের বিশ্লেষণ পদ্ধতির মধ্যে যে একটি নতুন সংখ্যায়নের বীজ নিহিত আছে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতন পদার্থবিদের তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই সত্যেন্দ্রনাথের পাঠানো গবেষণাপত্র আইনস্টাইন নিজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে এক বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। সেই সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের প্রবন্ধটির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে একটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য জুড়ে দেন। এই ভাবেই গড়ে ওঠে ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’! পরবর্তীকালে মূল রচয়িতার নামে এটি ‘বোস সংখ্যায়ন’ নামে সুপরিচিত হয়।
প্রকৃতিতে কেবল দুধরনের মৌল কণা রয়েছে। আর এইসব কণাদের একটি গ্রুপ ‘বোস সংখ্যায়ন’ মেনে চলে – যাদের বলা হয় ‘বোসোন’। আর অন্য গ্রুপের কণাগুলি ‘ফের্মি সংখ্যায়ন’ মেনে চলে – তাদের বলা হয় ‘ফের্মিয়ন’। এই নামকরণ করেছেন আর কেউ না , নোবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানী স্বয়ং পল ডিরাক । বিশ্বের তাবৎ মৌলিক কণার অর্ধেক-ই হল ‘বোসোন’! যাদের নামকরণ হয়েছে আমাদের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে।
বোস-সংখ্যায়নের সূত্র ধরে একাধিক বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার না-পাওয়ার ঘটনা শুধু আশ্চর্য-ই নয়, আর এক বঞ্চনার ইতিহাস।
বিভাগের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর আগ্রহের পরিধিতে ছিল জীববিদ্যা কিংবা রসায়ন , নৃতত্ত্ব , প্রত্নতত্ত্ব! পাশাপাশি সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা, দর্শন, ইতিহাস বিভাগেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।
সংগীত, চারুকলা ও গীতবাদ্যে তাঁর গভীর আগ্রহ উল্লেখ করার মতন! বস্তুত তিনি একজন নিমগ্ন সংগীত রসিক ছিলেন। বিশেষ করে যন্ত্রসংগীত ছিল তাঁর কাছে অতীব প্রিয়। বিশারদ প্রতিভাধরদের মতন তিনি এসরাজ বাজাতে পারতেন। সব ধরনের সংগীতেই ছিল তাঁর অনুরাগ।
স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্য। কবি বিষ্ণু দে-র সাপ্তাহিক সান্ধ্য আসরে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। এছাড়াও প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র’-আসর এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘বিশ্ব পরিচয়’ উৎসর্গ করেছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ-কে। বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশংকর রায় তাঁর ‘জাপানে’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ-কে! এছাড়াও, স্বনামধন্য কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘অর্কেষ্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থটি ! সত্যেন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতিতে ‘বিজ্ঞানের সংকট ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্যে ১৯৬৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক প্রদান করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ স্থাপন করেছেন , সর্ব সাধারণের কাছে বাংলায় বিজ্ঞান প্রচার, প্রসার এবং বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। ১৯৫৪ তে ভারত সরকার ‘পদ্মবিভূষণ’ প্রদান করে তাঁকে সম্মানিত করেন!
সৌজন্যেঃ
Siddhartha Majumdar আলোকসাগর পারে।
(ইষৎ সংক্ষেপিত এবং পরিমার্জিত)