প্রিয় ঔষধের দোকানদার ভাইদের জন্য একজন ডাক্তারের পক্ষ থেকে বিনা পয়সায় দেয়া কিছু দরকারি উপদেশঃ
(১) ভাইজানেরা, দয়া করিয়া আমার প্রেসক্রিপশনকে আপনার হিসাবের খাতা মনে করিয়া ভুল করিবেন না। কয়টা ঔষধ বিক্রয় করিলেন,ক’খানা বাকী রাখলেন এইসকল হিসাব আমার প্রেসক্রিপশনে করিয়া উহাকে ডাষ্টবিন বানাইয়া ফেলিবেন না প্লিজ।
(২) আপনার কলমটিকে সংযত করুন। অযথা ঔষধের পাশে টিক চিহ্ন দিয়া রোগীকে বিভ্রান্ত করিবেন না। কারণ,পরবর্তীতে যখন কোন কোন ঔষধ চলিবে বলিয়া আমি টিক দিয়া যাইব,তখন আপনার দাগের কারণে রোগী অহেতুক ভ্রান্তির ভিতরে পড়িবে।
(৩) কোন ঔষধ কোন রোগের জন্য প্রেসক্রাইব করা হইয়াছে এ নিয়ে খামাকা নিজের ক্ষুদ্র অসামান্য মস্তিষ্কের সামান্য ব্যবহার করিতে উদ্যত হইবেন না। কোন কোন ঔষধ কোন কোন রোগে ব্যবহার করা যাইবে,এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান নিয়েই একজন ডাক্তার ঔষধ লেখিয়া থাকেন। এই যেমন,মেটফরমিন ডায়াবেটিসের ঔষধ এইটা আমরাও জানি। কিন্তু এইটা ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে ইহা ব্যবহার করা যাবে এইটা সম্পর্কে আপনারা জানেন না । সুতরাং,অযথা আপনার অমৃতবাণী রোগীর উপর প্রয়োগ করিয়া রোগীকে ভীত সন্ত্রস্ত করিবেন না।
(৪) আমি কোন কোম্পানীর ঔষধ লিখিব বা না লিখিব ইহা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোনটা দামী আর কোনটা কমদামী কোম্পানী এইটা নিয়া গবেষণা করাটাও আপনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি কমদামী/দামী কোম্পানীর ঔষধ লিখিয়াছি বলিয়া রোগীর ভেতরে সন্দেহের বীজ বপন করা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার না। সুতুরাং, কলমের সাথে সাথে আপনার মুখটাকেও সংযত রাখুন।
(৫)ঔষধের দামকে প্রাধান্য দিয়া শুধু শুধু রোগীকে আমার উপরে ক্ষীপ্ত করিয়া তোলার অদম্য ইচ্ছাটা দমন করুন। মনে রাখিবেন,ঔষধের দাম অপেক্ষা অসুখের গুরুত্বটাই আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়।
(৬)নিজের কাছে কোন ঔষধ না থাকিলেই, আমি মার্কেট আউট ঔষধ লিখিয়াছি বলিয়া রোগীর সামনে মনগড়া মন্তব্য করিবেন না প্লিজ।
(৭) আমার ব্যবস্থাপত্র নিয়া গবেষণা করার অনধিকার চর্চা হইতে বিরত থাকুন।
(৮)আমার হাতের লেখা পড়িতে না পারিলে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার না করিয়া, এই ব্যবসা ছাড়িয়া দিয়া ধান-চালের ব্যবসায় নামিয়া পড়ুন।
(৯) আপনার দোকানে নাই বলিয়া আমার প্রেসক্রিপশনে লেখা ঔষধের পরিবর্তে অন্য কোম্পানীর একই ঔষধ কিংবা নিজের ইচ্ছানুযায়ী অন্য ঔষধ রোগীর নিকট গুছাইয়া দেওয়া বন্ধ করুন।
(১০)আমার প্রেসক্রিপশনে স্বহস্তে নোট লেখার পূর্বে আপনার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হন।
(১১)আমার প্রেসক্রিপশনে দেওয়া ঔষধ খাওয়ার নিয়ম-কানুন নিজে না বুঝিলে রোগীকে আমার নিকট পুনরায় প্রেরণ করুন। অহেতুক নিজের মনোমতো সেবনবিধি শিখাইয়া রোগীকে আরও ঝুঁকির দিকে ঠেলিয়া দিবেন না।
(১২)দয়া করিয়া ঔষধ বিক্রী করিবার ফাঁকেফাঁকে আমার প্রেসক্রিপশন মুখস্থ করিয়া অন্য রোগীর উপর প্রয়োগ করিবার সাহসিকতা দেখাইবেন না। ইহাতে হীতে বিপরীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
(১৩)আমার ডিগ্রী নিয়া ব্যবচ্ছেদ করার মত দুঃসাহস না দেখানোই উচিত।এমবিবিএস,এফসিপিএস,এমএস,এমসিপিএস,এমআরসিপি,এমআরসিওজি ইত্যাদি ডিগ্রীর বিস্তারিত রূপ উচ্চারণ করিতেই আপনার যেখানে দাঁত ভাঙিয়া যাইবে সেইখানে আপনি উহাদিগকে দাঁড়িপাল্লায় উঠানোর মত অসীম সাহসী কাজটিও নির্লজ্জের মত করেন, যাহা কাম্য নয়।
(১৪)আমার সামনে আসিয়া নিজের জ্ঞান জাহির করিবার চেষ্টা করিবেন না। ইহাতে যেকোন মুহূর্তে নিজের জ্ঞানের আলগা মুখোশ খুলিয়া পড়িয়া বিবস্ত্র হইয়া যাওয়ার আশঙ্কা অবশ্যম্ভাবী।
(১৫)যখনতখন রোগীকে আমার ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখিত সময়ের পূর্বেই ঔষধ বন্ধ করিবার নির্দেশ প্রদান করিবেন না। ঔষধ যখন আমি শুরু করিয়াছি,তখন বন্ধ করার ইখতেয়ারটা আমার কাছেই রাখুন।
(১৬)সকল রোগীর প্রেসার মাপিয়া তোতাপাখির মত লো-প্রেসার ঘোষণা দেয়া বন্ধ করুন। আর হ্যাঁ, উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ খাইলে রক্তচাপ নরমাল হইবে, এইটা যে নরমাল এইটুকু আইকিউ আপনার নাই ইহা আমরা জানি, আজ আপনিও জানিয়া রাখুন। কাজেই প্রেসার নরমাল হইয়া গিয়াছে বলিয়া প্রেসারের ঔষধ বন্ধ করার মত বোকামী আর করিবেন না। কারণ, উহা বন্ধ করা মাত্র রোগীর প্রেসার বাড়িয়া যেকোন দূর্ঘটনা ঘটিতে পারে যেকোন মুহূর্তে।
(১৭)স্যালাইনকে সকল রোগের মহাষৌধ গণ্য করা নিজেও বন্ধ করুন, রোগীদের ভেতরেও এই মহাজ্ঞান প্রসার করা হইতে বিরত থাকুন। এই যেমন বুকেপিঠে ব্যাথার রোগীও আপনার স্যালাইন থেরাপির হাত হইতে রেহাই পায় না। অথচ আপনি জানেন না, ওই রোগীর হার্টের সমস্যা থাকিলে আপনার পুসিং করা স্যালাইন তাহাকে পুসিং করিয়া দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত করিতে পারে।
(১৮)একই উপসর্গ যে একাধিক রোগ নির্দেশ করে এই জ্ঞান আপনার নাই। সুতরাং একটা লক্ষণের ঔষধ মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছেন বলিয়া উহা ওই লক্ষণের সকল রোগীর উপর প্রয়োগ করিবার বৃথা চেষ্টা করিবেন না। এই যেমন, রক্তস্রাবের রোগী হইলেই আপনি মেথারেশপ্যান কিংবা ট্র্যাক্সিল দিয়া রক্তবন্ধের চেষ্টা করেন। কিংবা শরীরে একটু পানি জমা দেখিলেই ল্যাসিক্স মারিয়া দেন। কোন কোন ক্ষেত্রে আপনাদের এইসকল অপাত্রে দান করা ঔষধ মহাবিপদ আনিতে পারে,এইটা আপনারা জানেন না।
(১৯) গর্ভবতীদের উপর আপনার ডাক্তারি জ্ঞান প্রয়োগ বন্ধ করুন। কারণ,আপনার অতিরিক্ত জ্ঞানের নীচে চাপা পড়িয়া দুইটি প্রাণ আসন্ন বিপদের মুখোমুখি পড়িতে পারে যেকোন সময়।
(২০)সবশেষ কথা,আপনার ব্যবসা আপনি করুন। আমারটা আমাকে করিতে দেন। অযথা আমার আলগা পালক কুড়াইয়া নিজের পুচ্ছে লাগাইয়া ময়ূর সাজার বৃথা চেষ্টা বন্ধ করুন।
© ডা.ফাহমিদা শিরীন নীলা
গাইনী কনসালটেন্ট,বগুড়া।