বইঃ- সংস্কৃতি কথা
লেখকঃ- মোতাহের হোসেন চৌধুরী
প্রথমেই বলব এই বইটি , এখন পর্যন্ত পড়া আমার সকল বইয়ের মাঝে অনন্য। কারণ এ বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধই একদিকে সমাজের অজ্ঞতা, গোঁড়ামি ভাঙতে উদ্যত। আরেকদিকে পুনরায়, নতুনভাবে সমাজ পত্তনের একটি উৎসাহ, তার সাথে ব্যক্তি মানুষের অন্তর জাগ্রতকারী। অন্যভাবে বলতে চাইলে, বইটিকে জ্ঞান ও সৌন্দর্যের এক মিশ্রণ বলা চলে। লেখকের নিপুণ ভাষাশৈলী /গদ্যভাষা মনে গাঢ় দাগ কেটে যায়।
এ বইয়ের আলোচনার মূল বিষয় মানুষ, জ্ঞান, মানুষ, সৌন্দর্য, মানুষ, রাষ্ট্র, মানুষ, শিক্ষা, মানুষ, সভ্যতা, মানুষ, সমাজ, মানুষ, ধর্ম। এখন যদি জানতে চান এতবার মানুষ আনার কারণ কী, তাহলে বলব এই বই সত্যই উপলব্ধি করায় যে, সবার উপরে মানুষের অবস্থান। যেমন মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। মানুষের সৃষ্টি ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। মানুষ তার সৃজনী দিয়ে গড়ে তুলেছে আধুনিক সভ্যতা। আর এ সকল কল্প-বাস্তবতা কেবল তার উপায় বা সাহায্য— লক্ষ্য নয়।
এই বইতে মোতাহের হোসেন ধর্মকে একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। এবং তিনি দেখিয়েছেন ধর্ম সবসময় মানবের কল্যাণই করে না। বরং মানুষ যখন কেবল শাস্ত্রের আদেশেই জীবন চালনা করে তখন তার মধ্যে একান্ত মনুষ্যত্ব বলতে কিছু জাগ্রত হয় না, হতে পারে না। আর সাধারণ মানুষ বা স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ স্বভাবিকভাবেই কোন্দলপ্রিয়।
তাই যখন তারা কোনো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার দরুন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যায় তা হয়ে উঠে মনুষ্যত্বের পরাজয়, মানব পরিচয়ের বিকার। তখন মানুষ পরিণত হয় ইতর কোনো প্রাণীর চেয়েও অধম। তিনি আমাদের আদেশপন্থি ধর্ম থেকে অনুপ্রেরণাপন্থি ধর্মের দিকে আহ্বান করেছেন, রবীন্দ্রনাথের মত আমাদের অন্তরে ধর্ম খোঁজার কথা বলেছেন।
তিনি আরো বলেছেন সৌন্দর্যের কথা। বলেছেন কবিতার কথা। তুলে ধরেছেন কাব্যের জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার দীপ্তি। তিনি বলেছেন যে, মানুষকে সময়ের সাথে সামনের দিকে বা অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি ও বিজ্ঞান। কিন্তু মানুষ উন্নত হচ্ছে বা সাধারণ প্রাণীর চেয়ে উঁচুতে যাচ্ছে বা গতিময় উর্ধ্বমুখে সাহিত্যের দরুন, সৌন্দর্যের দরুন। মানুষের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ এই সাহিত্য, এখানে বিজ্ঞান বেকার।
বিজ্ঞান কোনোদিন বলতে পারবে না সৌন্দর্য কি, প্রেম কি। কারণ মানুষ নিজের থেকে অনেক বিশাল কিছু সৃষ্টি করে যখন সে লিখে একটি সুন্দর কবিতা, অঙ্কন করে একটি চিত্র। আর এখানে মানুষই প্রভু, এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ এখানে অবাধ বিকাশের সুযোগ পায় বলেই একে যে কোনো প্রকার রীতিতে আবদ্ধ করা যাবে না। না সমাজের, না ধর্মের।
তারপর তিনি আরো বলেছেন মানবসভ্যতার পরিচয় মহাপুরুষেরা হলেও, বুদ্ধিজীবীদের অবদান আরো অনেক অনেক বেশি। তার কারণ প্রতিভাদের কাজ সমাজকে নাড়া দেয়া। আর বুদ্ধিজীবীদের কাজ সেই নাড়াতে সাড়া দেয়া। সেই নাড়া দেয়া প্রতিভাধর মহামানবদের কঠিন সমালোচনা করা কিংবা প্রশংসা করা। এবং আমরা জানি প্রতিভাকে বিকশিত করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।
রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন বড় কোনো লেখক বা কবি যদি কেনো সমালোচনাই না পায়, এর থেকে বড় অবমাননা তার জন্য আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালি মুসলমান সমাজে বুদ্ধিজীবীদের বড়ই অভাব, তাদের সংখ্যা খুবই কম। প্রতিভাকে তো সমালোচনা করার দূরের কথা ধারণ করারই কেউ নেই।
এজন্যই আমাদের দেশে মহাপুরুষের এত অভাব, অনেক প্রতিভা ঝরে গেছে মুকুলে, প্রস্ফুটনের আগেই। তবে আমাদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের অন্যতম কারণ আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। কিন্তু প্রধান সমস্যা শিক্ষা। কারণ যথার্থ শিক্ষা আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশাও দূর করবে মানুষ কেউ একটি সুন্দর জীবন দিবে।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সাহিত্যের সুন্দর একটি পর্যালোচনা চাইলেও এই বইটির মূল্য অনেক। এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনপ্রেমের আদর্শ ও কাব্যরচনা তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা। রবীন্দ্রনাথই যে প্রথমবারের মত বাংলা সাহিত্যে বৈরাগ্য কে প্রাধান্য না দিয়ে সংসারকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাও লেখক প্রমাণ করেছেন।
তারপর, নজরুল সাহিত্য কেনো এত জনপ্রিয় বা তার শিল্পমান ঠিক কতখানি তার ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও জ্ঞানগর্ভ আলাপ করেছেন। তিনি বলেছেন নজরুল ভালো কবি ও গীতিকার হলেও তার বুদ্ধির চর্চার অভাব দরুন তার শিল্পের মান খুব উৎকৃষ্ট নয়।
” শিল্পের জন্য বুদ্ধির দরকার। নজরুল ইসলামের বুদ্ধি চর্চা কম করেছিলেন বলে তাঁর রচনায় শিল্পগত ত্রুটি সুস্পষ্ট।… বুদ্ধিকে তিনি দস্তুর মতো ভয় করতেন। ”
এছাড়াও নজরুল শিল্পে সংশোধনে ও মার্জনাতে বেশি খাটুনি দেন নি। সেজন্য তিনি নজরুলকে বেশ কঠিন সমালোচনা করেছেন।
বলতে চাইলে আরো অনেক অনেক কিছু বলা যাবে। যেমনঃ- বাস্তব জীবনের সাথে শিক্ষার সম্পর্ক, শাস্ত্রের ও শিল্প সাহিত্যের দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের সাথে যুক্তিবিচারের নির্ভরতা, সংস্কৃতির বিবিধ আলোচনা। তবে এত বেশি বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য আগ্রহ সৃষ্টি করা, বইটি পড়তে আগ্রহী করা।
কেবল এই একটি বই পড়েই মোতাহের হোসেনের প্রতি আমার যে পরিমাণ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মেছে তা হয়তো অন্য কোনো লেখকের ৫ টি বই পড়লেও আসবে না। এই স্বল্পায়ু ( মাত্র ৫৩ বছর বয়সে বিদয় নেন) লেখকের এই বইটি সকল মুক্তমনা, উৎসুক ও জ্ঞানপিপাসু মানুষকে পড়তে অনুরোধ করছি, আহ্বান জানাচ্ছি। সেসময়ে এরকম একটি বই একজন নিভৃতচারী জ্ঞান-সাধক লিখেছেন বলে আমরা কৃতজ্ঞ। নিঃসন্দেহে এটি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।
লেখাঃ ১ জুলাই, ২০২০
পরিমার্জনঃ- ১৩ জানুয়ারি, ২০২১
মো. আরিফুল ইসলাম