বর্তমান প্রস্তাবিত হিন্দু আইন নিয়ে কিছু কথা…
Courtesy : S K Paul Shuvro দাদা
আমি একজন আইনের শিক্ষক ও ছাত্র হিসেবে যা বুঝি।
শুরুতেই বলে নেয় যে আমি পিতার সম্পত্তি তে কন্যার অংশের পক্ষে একমত।
প্রস্তাবিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সবথেকে আলোচিত অংশ এটি। প্রথমেই একটি কথা বলে নেয়া দরকার তা হল এই খসড়াটি অত্যন্ত কাচা হাতের। আইন প্রনয়নের সময় প্রতিটি শব্দ চয়ন ও ভাষা প্রয়োগে (এমন কি বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে) খুবই যত্নশীল হওয়া উচিত, যার প্রতিফলন এখানে ঘটেনি।
দুইটি বাক্যই যথেষ্ট অগোছালো । যেমন প্রথমে বলছে কোন হিন্দু নারী, পুরুষ বা হিজড়া ধর্মান্তরিত হলে, সে পাবে না, কিন্তু তার স্ত্রী পুত্র ও কন্যা তার সম্পত্তির অংশ পাবে। প্রশ্ন হল নারী ধর্মান্তরিত হলে তার স্বামীর ক্ষেত্রে কী হবে তা বলেনি। হিসাব দাড়ায় যে আমি যদি উত্তারাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার পূর্বে ধর্ম পরিবর্তন করি তবে আমি সম্পত্তি পাব না, পাবে আমার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা পাবে। খুবই ভাল কথা। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য অনুযায়ী, আমি যদি সম্পত্তি পাওয়ার পর অন্য ধর্মের কোন নারীকে ভালবেসে নিজের প্রথম পক্ষের হিন্দু স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা কে ত্যাগ করে নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে চলে যাই, তখন হিন্দু ধর্মে থেকে যাওয়া নিরপরাধ স্ত্রী, পুত্র-কন্যা পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি পাবে না। বরং আমার নতুন স্ত্রী, যিনি অন্য ধর্মের, এবং তার গর্ভজাত পুত্র- কন্যা সম্পত্তি পাবে। যা খুবই ভয়ংকর।
প্রতিনিয়তই দেখা যায় যে হিন্দুরা তাদের স্বামী / স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা কে রেখে অন্যের সাথে ধর্মান্তরিত হয়ে চলে যায়। আবার কখনো খুন ও করে। আপনারা মনে হয় রংপুরের সেই উকিলের কথা ভুলে যান নি, যার স্ত্রী এক মুসলিমের সাথে সম্পর্ক করে নিজের স্বামী কে মেরে মেঝেতে পুতে রেখেছিল। আবার কিছুদিন আগে দেখলাম কোথায় যেন এক পুরুষ তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা কে রেখে ধর্ম ত্যাগ করে চলে গেছে । এই সকল ক্ষেত্রে এই খসড়ার ভাষ্য অনুযায়ী পরিত্যাক্তা স্ত্রী ও তার সন্তানরা কিছু পাবে না, পাবে অন্য পক্ষের স্ত্রী সন্তান রা। আমার নিজের গ্রামের একটা ঘটনা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
আমাদের গ্রামের এক হিন্দু ডাক্তারের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল এক হিন্দু ছেলের সাথে। কিছু বছর সংসার করার পর এক মুসলিম ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এই ঘটনার পূর্বে ঐ ডাক্তার মারা যায়। যেহেতু মেয়ে হিন্দু থাকা অবস্থায় বাবা মারা গেছিল সেহেতু এই আইন যদি থাকতো তবে সে সম্পত্তি পেত। আর পরে সে যখন মুসলিমের হাত ধরে চলে গেল তখন তার সাথে সাথে বাবার থেকে পাওয়া সম্পত্তি ও চলে যেত ঐ মুসলিম স্বামী আর তার মুসলিম স্বামীর ঔরসে জন্ম পুত্র-কন্যার কাছে। আর তার পূর্বের পক্ষের যে হিন্দু স্বামী ও পুত্র-কন্যা আছে তারা পাবে কচু।
এরপর আসি আর একটা মারপ্যাঁচ এ। খসড়াতে বলছে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। নইলে নয়। এখানেই পুরনো কাসুন্দি নতুন মোড়কে দেবার সবথেকে বড় সুযোগ। এতদিন তারা যে কথা টা বলে প্রেমের ফাঁদে ফেলত এখন তা আরও সোজা হবে। বলবে যার ধর্ম তার থাকবে। বিয়ে হবে বিশেষ আইনে। বিয়ের পর আপনাকে খুব আদর যত্নে আগলে রাখবে। তারপর আপনি এবং আপনার বাবা মা ভাববে আপনার জামাই বা স্ত্রী অন্য ধর্মের হলেও খুব ভাল। দুই পরিবারের মধ্যে থাকবে যোগাযোগ। এরপর মা বাবার মৃত্যুর পর, আপনি যেহেতু অন্য ধর্মে যাননি, তাই সম্পত্তির ভাগ পাবেন। আর, যখন সম্পত্তি ভাগাভাগি শেষ তখন হবে খেলা শুরু। বাকীটা বুঝে নিন।
সবশেষে আইনের আর একটা প্যাঁচ খুলে দেই। এখানে বলেছে যদি কোন নারী বা পুরুষ অন্য ধর্মে যায়, কিন্তু তার স্বামী/স্ত্রী ও পুত্রকন্যা যদি ধর্মান্তরিত না হয় তবে ঐ ধর্মান্তরিত না হওয়া স্বামী / স্ত্রী ও তার পুত্রকন্যা সম্পত্তি পাবে, কেবল ধর্মান্তরিত হওয়া ব্যক্তি টী সম্পত্তি পাবে না। ধরে নিন, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বা চাঁদের মেয়ে জ্যোৎস্না হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে রূপনগরের ভিন্নধর্মী রাজকুমারের সাথে বিয়ে করল। জ্যোৎস্না যেহেতু ধর্ম ত্যাগ করেছে তাই সে তার বাবার সম্পত্তি পাবে না। কিন্তু ঐ রাজকুরার তো তার ধর্ম ত্যাগ করেনি, সে তার পূর্বের ধর্মেই আছে (শুরু থেকেই তো সে অহিন্দু) তাই সে জ্যোৎস্নার ভাগের সম্পত্তি টা জ্যোৎস্নার বাবার থেকে পাবে। যার জন্য জ্যোৎস্না নিজে বাবার সম্পত্তি পেল না, সে ঠিক ই সম্পত্তি পাচ্ছে। নিজের পুত্রকন্যা ভিন্নধর্মী হলে সম্পত্তি পাবে না , কিন্তু তাদের স্বামী বা স্ত্রী ভিন্ন ধর্মী হলেও ঠিকই শ্বশুর এর থেকে সম্পত্তি পাবে। বা…… আইন আর এর খসড়া।
এই বার আসি মূল প্রসঙ্গে। নারীদের সম্পত্তি ভাগ নিশ্চিত করা এই খসড়ার মূল বক্তব্য, বিশেষ করে বিধবা এবং স্বামী পরিত্যাক্তা নারীদের জন্য। আমি এই যুক্তি এবং পিতার সম্পত্তি তে কন্যার অংশের পক্ষে একমত। কিন্তু যে স্বামীপরিত্যাক্তা নারীদের জন্য এতকিছু তাদের কি আখেরে কোন লাভ আছে এই আইনে?
না নেই। উদাহরণ দিচ্ছি। আবার আসি সেই বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বা চাঁদের মেয়ে জ্যোৎস্না এর প্রসঙ্গে। ধরে নিন জ্যোৎস্না ধর্ম ত্যাগ করে রাজকুমারকে বিয়ে করার কারণে বাবার সম্পত্তি পেল না। আবার রাজকুমার ও বিয়ের দুই তিন বছরের মাথায় অন্য মেয়েকে বিয়ে করে জ্যোৎস্নাকে ডিভোর্স দিল। জ্যোৎস্না এই দিকে রাজকুমারের থেকে গলাধাক্কা ছাড়া কিছু পেল না। তখন জ্যোৎস্না কোথায় যাবে, কি নিয়ে থাকবে? দিনশেষে সেই পতিতালয়।
অতএব, নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা, সুন্দর জীবন নিশ্চিত ও ধর্মান্তর রোধে আমার কিছু সংশোধনী প্রস্তাব আছে। আবার পগলের প্রলাপ ও বলতে পারেন। সময় থাকলে ভেবে দেখবেন।
১) যৌতুক পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। নইলে প্রথমে বিয়েতে যৌতুক আর পরে বাবার সম্পত্তি তে সমান ভাগ, এই নিয়ে ভাইবোনের সম্পর্ক গুলো নরকের যন্ত্রণার সৃষ্টি করবে। যদি বিয়েতে যৌতুক প্রদান হয়ে থাকে তবে তা সম্পত্তি বণ্টনের সময় বিবেচনায় নিয়ে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এখানেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপত্তি। আপনি যদি মা-বাবার সম্পত্তি বণ্টনের সময় যৌতুকের বিষয় বিবেচনায় আনেন তবে, প্রকারন্তরে যৌতুককেই বৈধতা দান করা হয়, যা বাঞ্ছনীয় নয়। আর যদি যৌতুকের বিষয় বাদ দেন তবে ভাইয়েরা সম্পত্তি তে ন্যায্যতা পায় না। এমন কি একাধিক বোনের ক্ষেত্রে, বোনেদের মাঝেও ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় না। কারণ বিভিন্ন কারণে এক এক মেয়ের বিয়ের জন্য পরিবার কে এক এক পরিমাণ যৌতুক দিতে হয়। কোন মেয়ের বিয়েতে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়, কোন মেয়ের বিয়েতে ১ টাকাও দিতে হয় না। এরপর যখন তাদের মধ্যে সম্পত্তি সমান ভাবে ভাগ করে দিবেন তখন ন্যায্যতা কিভাবে হবে?
(যদিও আমার দাদার বিয়েতে এবং আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় আমার মা-বাবা যৌতুক দাবী করেছে ও নিয়েছে। যৌতুকের দাবী ছিল পাত্রীর পিতৃগৃহের লক্ষ্মী টাই, আর কিছু নয়।)
২) সম্পত্তি পাওয়ার আগে হোক বা পরে, যখনি কোন ব্যক্তি ধর্ম ত্যাগ করবে সে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সকল সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে। যদি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেও থাকে তবে তা ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে, অন্যথায় তার স্থাবর -অস্থাবর সকল সম্পত্তি ক্রোক করে সরকারী পাওনা আদায় এর মত করে উসূল করা হবে।
৩) বিবাহের সাথে সাথেই স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীদের অর্ধেক অধিকার জন্মাবে। মিতাক্ষরা মতবাদে যৌথ পরিবারিক সম্পত্তি আইনে এই বিধি আছে। সেটাকেই আমরা এখানে আনতে পারি। কোন হিন্দু যদি অন্য কোন ধর্মের কাউকে বিয়ে করে সেখানেও এই নিয়ম কার্যকর করতে হবে। নিজের সম্পত্তি থেকে ভাগ দেবার ভয়ে অন্য ধর্মের কেউ তখন হিন্দু কাউকে বিয়ে করার মতলব করবে না। আর যদি করেও থাকে তবে, ভবিষ্যতে যদি কখনো সে স্ত্রীকে তালাক দেয় তখন ঐ নারী স্বামীর থেকে একটা ভাল সম্পত্তি সাথে করে আনতে পারবে।